শিক্ষাঙ্গনে যৌন নির্যাতন বন্ধ করবে কে?

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে একই বিভাগের দুই ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত শিক্ষকের শাস্তির দাবিতে সেখানে আন্দোলন চলছে। ওই শিক্ষককে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে অব্যাহতির আদেশ কপিতে লেখা আছে, ‘অভিযুক্ত যৌন নিপীড়ক আক্কাস আলীকে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ আর ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে’। তাহলে এ আদেশ কপির ভাষা থেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে যৌন হয়রানির শিকার শিক্ষার্থীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ সাময়িক অব্যাহতির বিষয় ঘটেনি। তাহলে যদি পত্রিকায় প্রকাশ না ঘটত কিংবা ছাত্র আন্দোলন না হতো, তাহলে এই অভিযোগকে আমলেই নিত না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন?

আসলেই হয়তো তা–ই। প্রশাসনের ভাষ্যে যে তারই প্রমাণ মেলে। কারণ, আন্দোলনের আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, তারা এ অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত নয়, অথচ শিক্ষার্থীরা অভিযোগ দাখিল করেছেন এক মাস আগেই। তবে প্রশাসন স্বীকার করেছে, ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আগেও এ ধরনের অভিযোগ হয়েছে ও প্রশাসন থেকে তাঁকে মৌখিকভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে এবং ওই অভিযুক্ত শিক্ষক কোনো থিসিস তত্ত্বাবধান করতে পারবেন না বলে সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছিল।

অভিযুক্ত শিক্ষককে সাময়িক অব্যাহতির পাশাপাশি এ ঘটনা তদন্তে বিজ্ঞান অনুষদের ডিন আবদুর রহিম খানকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে এবং আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির এ অভিযোগ আমাদের আবারও দেখিয়েছে যে যৌন নির্যাতনের প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয়ে ২০০৯ সালে হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দেন, সেটি আইনে রূপান্তর না হওয়া পর্যন্ত সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ নির্দেশনাই আইন হিসেবে কাজ করবে এবং সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রের জন্য এ নীতিমালা প্রযোজ্য। কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র তা মানছে না এবং এই নির্দেশ মানা ও না মানার বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো নজরদারি নেই। এ যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেল গঠন করার বিষয়কে অগ্রাহ্য করেছে প্রশাসন। এখানে আরও বলা প্রয়োজন যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি যৌন হয়রানির তদন্তের জন্য তৈরি করা কমিটি হাইকোর্টের এ নির্দেশিকা মেনে হয়নি। নীতিমালা অনুযায়ী, সব প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট অভিযোগ কমিটি গঠন করার কথা, যার বেশির ভাগ সদস্য হবেন নারী এবং সম্ভব হলে কমিটির প্রধান হবেন নারী। কমিটির দুজন সদস্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠানের হতে হবে। এসবের কিছুরই ধার ধারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিষয় সামনে এসেছে। অভিযোগ উঠেছে শিক্ষক, ছাত্র ও সহকর্মীর বিরুদ্ধে। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের একটি গবেষণার ২০১৮ সালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, ৮৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালের সুপ্রিম কোর্টের দিকনির্দেশনা জানেন না। কর্মক্ষেত্রেও এ হার ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু কার্যত এ নির্দেশনার বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অমনোযোগিতা ও গুরুত্বের অভাবে যৌন হয়রানির মতো ঘটনা বারবার ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে এমনও ঘটেছে যে অভিযোগকারীকে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যেতে হয়েছে, কিন্তু অভিযুক্তের কোনো শাস্তি হয়নি।

এ বিষয়ে সচেতনতা ও জনমত তৈরির জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনায় আরও আছে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতি শিক্ষাবর্ষের প্রারম্ভে কাজ শুরুর আগে শিক্ষার্থীদের এবং সব কর্মক্ষেত্রে মাসিক ও ষাণ্মাসিক ওরিয়েন্টশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এর পাশাপাশি সংবিধানে বর্ণিত লিঙ্গীয় সমতা ও যৌন নিপীড়ন সম্পর্কিত দিকনির্দেশনাটি বই আকারে প্রকাশ করতে হবে।

 ১৯৯৮ সালে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের সময় যৌন হয়রানিবিষয়ক নীতিমালা ও এ বিষয়ে তদন্ত সেল গঠনের আওয়াজ প্রথম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আসে। তবে খুব অল্পসংখ্যক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ সেল গঠন ও যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও কয়েক দফা নোটিশ পাঠাতে হয়েছিল আদালতকে। তবে সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যে আদালতের নজরদারিতে নেই, তা বোঝাই যায় সাম্প্রতিক ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করলেই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই যখন এ দশা, তখন কলজ ও স্কুলগুলোতে যে কমিটি নেই, সেখানকার পরিস্থিতি সহজেই আন্দাজ করা যায়। তবে দুই–একটি ব্যতিক্রম হয়তো আছে। আবার কয়েকটিতে হয়তো কমিটি আছে, কিন্তু কার্যকর নয়। কীভাবে কমিটি কাজ করবে, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনার অভাব আছে। যৌন হয়রানির প্রতিকার বিষয়ে পুরুষতান্ত্রিক উদাসীনতা, আধিপত্যের সঙ্গে সামাজিক অস্বতঃস্ফূর্ততাজনিত অদক্ষতার মিলন একভাবে হাইকোর্টের যুগান্তকারী দিকনির্দেশনাটিকে অকার্যকর করে রেখেছে, যেন কিছুতেই এটি কার্যকর হতে না পারে।

যৌন হয়রানির বিষয়ে আমাদের গাফিলতি আসলে সাহসী করে তোলে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদৌলা কিংবা আক্কাস নামের যৌন নিপীড়ক শিক্ষকদের। এর ফলাফল হিসেবে কেউ লড়ছে রাজপথে বিচারের দাবিতে, কেউ মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে। কেন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রগুলোতে যৌন হয়রানির বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশ মানা হয়নি এখনো?

 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি এ নির্দেশনা সম্পর্কে জানত না? না জানলেও এ বিষয়ে নৈতিক অবস্থান দৃঢ় থাকলে হয়তো জানার চেষ্টা আগেই করত। করবে কেন? শিক্ষার্থীর নিপীড়নের অভিযোগ খারিজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠুনকো ‘ভাবমূর্তি’ ও নিপীড়ককে রক্ষা করাই যাদের কাজের অন্যতম অংশ হয়ে ওঠে, তারা যে হাইকোর্টের নির্দেশনার সঙ্গে কানামাছি খেলবে, সেটি তো মোটা দাগে জানা কথা। তবে এখন বোধ হয় এ বিষয়ে হাইকোর্টের জোরসে ঝাঁকুনির সময় এসেছে।

জোবাইদা নাসরীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
[email protected]