ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সফর

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর গত শুক্রবার প্রথম যে বিদেশি সরকারপ্রধান বাংলাদেশে এলেন, তিনি ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং। তিনি যেহেতু নব্বইয়ের দশকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ার জন্য বাংলাদেশে ১০ বছর ছিলেন, সেহেতু বাংলাদেশের সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়টিও কম–বেশি তাঁর জানা। এখানে অবস্থানকালে ভুটানি নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছাড়াও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বসেছেন। যোগ দিয়েছেন ঢাকা ও ময়মনসিংহে বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানেও।

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করতে যে বাণিজ্য ও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন, সেটি যৌক্তিক বলে মনে করি। যোগাযোগ যত বাড়বে, সম্পর্কও তত সুদৃঢ় হবে। লোটে শেরিং বলেছেন, যেখানে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, সেখানে ভুটানে রপ্তানির পরিমাণ মাত্র ৩ মিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ রপ্তানি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বাংলাদেশ ১০টি পণ্যের ওপর এবং ভুটান ১৬টি পণে্যর ওপর শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা চেয়েছে। দুই পক্ষ এ ব্যাপারে নীতিগত একমত হলেও কোন কোন পণ্যের ওপর তা প্রযোজ্য হবে, সেটি এখনো ঠিক হয়নি।

বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে যে উপ-আঞ্চলিক জোট— বিবিআইএন গঠন করা হয়েছিল, তার লক্ষ্যও ছিল পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়ানো, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা। এ নিয়ে অনেক আলোচনা-বৈঠক হলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি সামান্য। বিবিআইএন দেশগুলোর মধ্যে সড়ক যোগযোগ চুক্তি হয়েছিল, যাতে এক দেশের যানবাহন অন্য দেশের ওপর দিয়ে চলাচল করার কথা আছে। কিন্তু পরিবেশদূষণ হতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে ভুটানের সংসদ তা অনুমোদন করেনি। এবারের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং দেশটি যাতে সীমিত পর্যায়ে সড়ক যোগাযোগের সুবিধা দেয়, সেই অনুরোধ পুনর্ব্যক্ত করেন। ভুটানের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে চার দেশীয় সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি হবে কি হবে না।

আমরা মনে করি, দুই দেশের জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে যোগাযোগ সহজ করার বিকল্প নেই। ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে স্বাস্থ্য, কৃষি, জাহাজ চলাচল, পর্যটন ও জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ বিষয়ে সহযোগিতা জোরদারে ঢাকা ও থিম্পুর মধ্যে পাঁচটি চুক্তি সই হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের শিল্প ও
বণিক সমিতির মধ্যেও একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে। এগুলো নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।

দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর চেয়েও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি হলো পানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার সুরাহা, যা প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও ভুটানের সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। আবার এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, এ অঞ্চলের সবগুলো দেশই লাভবান হবে। বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই পানি সমস্যা সমাধানে অববাহিকাভিত্তিক যৌথ প্রকল্পের কথা বলে আসছিল। ভারত অতীতে এই প্রস্তাবে রাজি না হলেও সাম্প্রতিক কালে তাদের মনোভাব ইতিবাচক বলে জানা গেছে। অন্যদিকে নেপাল ও ভুটানের যে বিপুল পরিমাণ পানিসম্পদ আছে, সেটি কাজে লাগিয়ে যৌথ পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভুটানে ৩০ হাজার মেগাওয়াট পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু উৎপাদিত হচ্ছে মাত্র ৫ হাজার মেগাওয়াট । যৌথ উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের জ্বালানি সমস্যা অনেকটাই মিটে যাবে।

তবে বাংলাদেশ-ভুটান বা বাংলাদেশ-নেপাল যৌথ পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করতে হলে ভারতের সম্মতি ও সহায়তা প্রয়োজন। যে প্রকল্পে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও ভারত—চার দেশই লাভবান হতে পারে, সে প্রকল্প নীতিনির্ধারকদের অধিকতর মনোযোগ দাবি করে। অন্যথায় বিবিআইএন বা উপ-আঞ্চলিক জোট শুধু বাগাড়ম্বর হয়েই থাকবে।