শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিরাপদ হবে কবে?

মাদ্রাসার শিক্ষকের যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করেছিলেন নুসরাত, আর তারই জেরে পৃথিবী ছেড়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। প্রশ্ন জাগে, কী করে একজন মাদ্রাসার ‘শিক্ষক’ এতটা দুঃসাহস পান? এ ঘটনায় বোঝা যায় যে আরও অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতোই ওই মাদ্রাসাতে যৌন পীড়নের বিরুদ্ধে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছিল না, যা প্রতিরোধ করতে পারত নুসরাতের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অপরাধকে। একই সঙ্গে একের পর এক অপরাধের মামলায় সহজেই জামিনে মুক্তি পাওয়া আর চারপাশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ আর যৌন সহিংসতার বিচার না হওয়া নিশ্চয়ই আরও সাহস জুগিয়েছে এই যৌন হয়রানিকারী শিক্ষককে। আইনের উপস্থিতির বোধ আর বিচারের ভীতি কতটুকু কম হলে অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য হাত-পা বেঁধে একজন জীবিত মানুষকে পুড়িয়ে মারার মতো ভয়াবহ পরিকল্পনা পর্যন্ত করা যায়! নুসরাতের পোড়া মৃতদেহটা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের এগিয়ে চলার পথে কত বড় সংকট এই সহিংসতা আর বিচারহীনতার বাস্তবতা।

যদি চিন্তা করা যায়, কেমন পরিবেশ প্রতিরোধ করতে পারত এ ঘটনাকে। তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, মাদ্রাসাটিতে যাঁরা পড়াচ্ছেন, পড়ছেন বা যাঁরা প্রশাসনিক দায়িত্বে আছেন, তাঁরা কতটুকু সচেতন যৌন হয়রানি সম্বন্ধে? গবেষণা কিন্তু বলছে, অধিকাংশ ব্যক্তি জানেনই না যে যৌন হয়রানি আসলে কাকে বলে। একটি অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, একটি উচ্চারিত শব্দ বা অঙ্গভঙ্গিও যে যৌন হয়রানি হতে পারে, জানা নেই অনেকেরই। ফলে যুগ যুগ ধরে যৌন হয়রানিমূলক অনেক আচরণকেই সমাজ বৈধতা দিয়ে আসছে। একটি মেয়ে যখন অভিযোগ তুলছে যৌন হয়রানির, তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে শোনা হচ্ছে না। কেননা, ধর্ষণ ছাড়া আর কোনোটিই তো সাধারণের চোখে অপরাধ নয়।

একই সঙ্গে ভাবার বিষয়, দেশের প্রচলিত আইন কী বলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি সম্পর্কে। সেই ২০০৮ সালে নারী সংগঠনগুলোর উদ্যোগে একটি জনস্বার্থ মামলা করা হয়েছিল উচ্চ আদালতে। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সুপ্রিম কোর্ট ২০০৯ সালে একটি বিস্তারিত নির্দেশনাবলি দিয়েছিলেন যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে, যা কিনা সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য করা হয়। আদালত সিদ্ধান্তটিতে একাধিকবার উল্লেখ করেন যে যত দিন না পর্যন্ত যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কোনো আলাদা আইন করা হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত এই নির্দেশগুলোই আইন হিসেবে কার্যকর থাকবে। অর্থাৎ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রের জন্য ২০০৯ সালের এই নির্দেশগুলো মানা আইনত বাধ্যতামূলক।

২০০৯-এর সিদ্ধান্তটিতে প্রথমত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির ওপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে, সেখানে সবাইকে যৌন হয়রানির সংজ্ঞা, প্রচলিত আইন এবং আদালতের নির্দেশনাবলি সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে সিদ্ধান্তটিতে সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য হতে হবে নারী এবং অন্ততপক্ষে দুজন সদস্যকে প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কমিটির তদন্তপ্রক্রিয়া এবং সিদ্ধান্ত
প্রদানের ব্যাপারেও নির্দেশনা রয়েছে রায়টিতে। এই রায়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যৌন হয়রানির একটি বিস্তারিত সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সংজ্ঞাগুলোর অনেকটাই কাছাকাছি।

২০০৯-এর এই রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রের জন্য বাধ্যতামূলক হলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ওই রায়ের কোনো রকম বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আর হাতে গোনা কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া এই রায়ের প্রয়োগ নেই কোথাও। বিশেষ করে, স্কুল-কলেজের অধিকাংশ কর্তৃপক্ষ জানেই না যে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আদালতের কোনো নির্দেশ আছে। তা ছাড়া রায়ে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক যে পদক্ষেপগুলো নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে, তা-ও একেবারেই উপেক্ষিত। আর তাই সরকারের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের ওপর আইনত দায়িত্ব বর্তায়, এই নির্দেশাবলির কতটুকু মানা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা। সরকারের পক্ষ থেকে এই রায়ের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করাও খুবই জরুরি।

পাশাপাশি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করতে একটি কার্যকরী পৃথক আইনের প্রয়োজন, যেমনটা আমাদের উচ্চ আদালত ২০০৯-এর রায়ে উল্লেখ করেছেন। যদিও বেশ কয়েক বছর ধরেই এ রকম একটি আইনের খসড়া নিয়ে কথা হচ্ছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের মধ্যে, কিন্তু এই উদ্যোগগুলো খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি।

২০০৯-এর এই রায়ের পাশাপাশি আমাদের প্রচলিত ফৌজদারি আইনগুলোতেও কিছু ধারা রয়েছে। তবে প্রচলিত আইনগুলোতে কোথাও ‘যৌন হয়রানি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। প্রতিটি ধারাতেই নারীর ‘শ্লীলতাহানি’কে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ধরা হয়েছে। কিন্তু নারীর ‘শ্লীলতা’ বলতে আসলে কী বোঝায় আর কীভাবে তা ‘হানি’ হয়, সে ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা নেই। এই ধারাগুলোতে সেই পিতৃতান্ত্রিক ধারণা দিয়ে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনকে দেখা হয় একজন নারীর মর্যাদা ও সম্মানহানির কারণ হিসেবে, অধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে নয়। স্বভাবতই দণ্ডবিধির এই ধারাগুলোতে মামলার সংখ্যাও নগণ্য।

আশ্চর্যজনক হলো, নারীর প্রতি সহিংসতা দমনে আমাদের একটি পৃথক আইন থাকলেও সেখানে যৌন হয়রানি অপরাধটি কোথাও স্থান পায়নি। দুঃখজনক যে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটির মূল দলিলে ‘যৌন হয়রানি’ নামে পৃথক একটি ধারা থাকলেও ২০০৩ সালে এটি সংশোধনের মাধ্যমে এই ধারা মুছে ফেলা হয়েছে। যদিও এর কারণ স্পষ্টভাবে কোথাও উল্লেখ নেই। তবে সেই সময়ের কিছু প্রতিবেদনে ইঙ্গিত রয়েছে যে এই ধারা আইনের অপব্যবহারের সুযোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে, যেহেতু ‘যৌন হয়রানি’ শব্দটির কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যদিও ২০১০ সালে করা আরেকটি জনস্বার্থ মামলার অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার থেকে বলা হয়েছিল যে ওই ধারা আবার সংযোজন করা হবে, এই পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সব মিলিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধে প্রচলিত আইনি কাঠামো একেবারেই দুর্বল। তবে এটিও সত্য যে শুধু আইন করে যৌন হয়রানিকে প্রতিরোধ করা যাবে না। বরং ব্যক্তিপর্যায়ে এই সহিংসতা আর বিচারহীনতার বিরুদ্ধে আমরা যেমন সোচ্চার, সেই চেতনা আর আওয়াজকেই সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিতে হবে। সেই সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হবে রাষ্ট্রকেই।

তাসলিমা ইয়াসমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক