দিনাজপুরের বেহাল গ্রন্থাগার

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়ে রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুরের অনেক গ্রন্থাগারে বিভিন্ন সময়ে গিয়েছি। শেষবারে গিয়েছি দিনাজপুরের কয়েকটি গ্রন্থাগারে। আমার সঙ্গে ছিলেন প্রায় ৭০ জন শিক্ষার্থী। দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক আলাউদ্দীন আমাদের সঙ্গে নিয়ে গ্রন্থাগার দেখাচ্ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারটি বেশ সাজানো। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা গ্রন্থাগারের কয়েকটি কক্ষ নান্দনিক রূপে সাজিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টি অতীতে কৃষি কলেজ ছিল। সেই সময়ের গ্রন্থাগারটিকেই বৃহৎ পরিসরে তৈরি করা হয়েছে। প্রায় ৪০ বছর ধরে এই গ্রন্থাগারের দায়িত্ব পালন করার কথা উল্লেখ করে গ্রন্থাগারিক আলাউদ্দীন বলছিলেন, ‘মাত্র ৩০০টি বই নিয়ে এ গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু করেছিলাম। এখন এখানে বইয়ের সংখ্যা ৩৩ হাজার।’ গ্রন্থাগারে ঢোকার সময় দেখছিলাম ব্যাগ রাখার স্থানে কোথাও খালি নেই। বোঝা যাচ্ছিল অনেক
পাঠক আছেন ভেতরে। গ্রন্থাগারিক জানালেন, সেখানে ২৫০ জনের বসার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এতে স্থান সংকুলান হয় না। সে জন্য তাঁরা আরেকটি ভবনের নিচতলাকেও পাঠকক্ষ হিসেবে নিয়েছেন। প্রায় ৩০টি সিসি ক্যামেরা দিয়ে সম্পূর্ণ গ্রন্থাগারটি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এতে কেউ যেমন বইয়ের
ক্ষতি করতে পারে না, তেমনি পড়ার নাম করে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করতে পারে না। গ্রন্থাগারিক আলাউদ্দীন বলছিলেন, ‘আমার দুজন মেয়ে আছে। আর সেই সঙ্গে এই লাইব্রেরির সব বই আমার সন্তানের মতোই। সন্তানের মতোই এগুলোকে আমি ভালোবাসি এবং এগুলোর পরিচর্যা করি।’

দিনাজপুর সরকারি কলেজের অধ্যাপক কবি ও গবেষক মাসুদুল হকের সঙ্গে আগেই কথা হয়েছিল আমাদের দিনাজপুরে যাওয়ার বিষয়ে। শহরের কালিতলায় মকবুল হোসেনের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার দেখানোর জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন। মকবুল হোসেনের বয়স প্রায় ৭৫ বছর। বঙ্গবন্ধুর সময়ে রাজনীতি করেছেন। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেও তাঁর অনেক বই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের বাড়ি পুড়িয়ে দিলে সব বই পুড়ে যায়। যুদ্ধের পর নতুন করে বই সংগ্রহ শুরু করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনার পর অনেক দিন বাড়িতে থাকতে পারেননি। একটি বড় কাঠের বাক্সে বইগুলো রেখে প্রায় এক বছর বাড়ির বাইরে ছিলেন। বাড়িতে এসে দেখেন সব বই উই পোকায় কেটেছে। নতুন করে আবারও বই সংগ্রহ শুরু করেন। বর্তমানে তাঁর সংগ্রহ করা বইয়ের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। গত গ্রন্থাগার দিবসে জেলা প্রশাসন তাঁকে এ কাজের জন্য সম্মাননা প্রদান করেছে।

আমরা মকবুল হোসেনের বাসায় উঠে তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি দেখলাম, রীতিমতো অবাক করার মতো একটি লাইব্রেরি। সারা জীবন ধরে তিনি শুধু বই সংগ্রহ করেছেন এবং পড়েছেন। তাঁর ওখানে অনেক পুরোনো প্রকাশনাও আছে। বেগম, সওগাত পত্রিকার মূল কপিও সংগ্রহে রেখেছেন। এই পাঠাগার পরিদর্শনের পর গিয়েছিলাম দিনাজপুর সরকারি গণগ্রন্থাগারে। এই গ্রন্থাগারে পাঠকসংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়। গ্রন্থাগারের বই গ্রহণ খাতায় দেখলাম মাসে ৭ থেকে ১০ জন পাঠক বই নেন। সেই বইয়ের মধ্যে সাধারণ জ্ঞানের বইও আছে। যাঁরা পাঠক আসেন, তাঁদের অনেকেই আসেন দৈনিক পত্রিকা পড়ার জন্য এবং চাকরির পরীক্ষার বই খুঁজতে। স্কুলের শিক্ষার্থীরা বেশি আসে।

সরকারি গণগ্রন্থাগারের পর আমরা গিয়েছিলাম শহরের মুন্সিপাড়ায় হেমায়েত আলী পাবলিক লাইব্রেরিতে। হেমায়েত আলী লাইব্রেরির পুরোনো নাম খাজা নাজিম উদ্দীন লাইব্রেরি। মকবুল হোসেন নেতৃত্ব দিয়ে প্রায় ১০ বছর ধরে আন্দোলন করেছেন এই গ্রন্থাগারের নাম পরিবর্তনের জন্য। গত মার্চ মাসে সেই নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। দেয়ালে খোদাই করা নামের ওপরে ডিজিটাল একটি ব্যানারে লেখা হয়েছে হেমায়েত আলী লাইব্রেরি। সেখানে লেখা আছে প্রতিষ্ঠিত ১৯৩১ সাল। এই গ্রন্থাগারটি দুটি ভবনে।

ভবন দুটিতে বই আর বই। বেশ কিছু পুরোনো পুঁথিও আছে। পরিতাপের বিষয়, অযত্নে সেগুলো ধ্বংস হচ্ছে। মাসুদুল হক বলছিলেন, ‘আমি যখন পিএইচডি ডিগ্রি করেছি, তখন এ গ্রন্থাগারের অনেক বই আমার গবেষণার কাজে লেগেছে।’ এত পুরোনো বইয়ের সংগ্রহ রংপুর বিভাগের আর কোথাও নেই। দিনাজপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে এ গ্রন্থাগারের বইগুলোর যথাযথ পরিচর্যা রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা জরুরি। তা না হলে এগুলো নিকট ভবিষ্যতে নষ্ট হবে।

রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুরের দু-একটা পাঠাগার ছাড়া কোনো পাঠাগারের অবস্থাই সন্তোষজনক নয়। যে দেশে পাঠাগারের এত করুণ দশা, সে দেশে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির আশা দুরাশা মাত্র।

তুহিন ওয়াদুদ: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপল–এর পরিচালক
[email protected]