নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ হবে কবে?

দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের বহু পদ শূন্য রয়েছে বলে জানা যায়। ফলে চরম ভোগান্তিতে আছে বিশেষ করে দূরদূরান্তের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর ওপর নির্ভরশীল জনগণ। এর প্রতিকার করতে বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে শূন্য পদ পূরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, দুই দফায় ৫ হাজার করে ১০ হাজার ডাক্তার দ্রুত নিয়োগ দেওয়া হবে। এ পটভূমিকায় ৪ হাজার ৫৪২ জন চিকিৎসক ও ২৫০ জন দন্তচিকিৎসক নিয়োগের জন্য ৩৯তম বিসিএস পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল জারি হয় সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) পরিপত্র। চিকিৎসক ও দন্তচিকিত্সকের প্রাথমিক যোগ্যতা হতে হয় যথাক্রমে এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রি। ৩৯ হাজার ৯৫৪ জন আবেদন করেন। ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিয়ে ১৩ হাজার ২১৯ জনকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। কিছুদিন আগে মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আশা করা যায়, শিগগিরই নিয়োগের জন্য সুপারিশ যাবে সরকারের কাছে।

মাসখানেক আগে সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে বলা হয়, দুই মাসের মধ্যে ৫ হাজার ডাক্তার নিয়োগ পাবেন। কিন্তু প্রক্রিয়াটি এখনো অনেক দূর। তবে নিয়োগ হলে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা সমৃদ্ধ হবে। চাকরি হবে বেকার ডাক্তারদের। অন্যদিকে বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে অপরাপর কার্যক্রমের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা না নিলে নিয়োগ পিছিয়ে যাবে। ফলে ব্যাহত হবে উদ্দেশ্য। গত কিছুকাল দেখা যাচ্ছে, বিসিএস পরীক্ষায় পিএসসির সুপারিশের পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্বভাবচরিত্র–সংক্রান্ত প্রতিবেদনের জন্য বছরখানেকের মতো সময় নেওয়া হয়। এটা বেশ কম সময়ে করা যায়, এ মর্মে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। একই তালে চলছে এসব প্রক্রিয়া। বিসিএস পরীক্ষায় বিভিন্ন ক্যাডার মিলে হাজার দেড়েক নিয়োগের সুপারিশ পান। এটা চূড়ান্ত করতেই যদি এত সময় লাগে, তাহলে একই ধাঁচে ফেললে ৫ হাজার ডাক্তারের জন্য সময় কত লাগবে, তা সহজেই অনুমেয়।

পিএসসি প্রিলিমিনারি পরীক্ষা থেকে শূন্য পদে দ্বিগুণসংখ্যক প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় ডাকলে সংখ্যা দাঁড়াত সাড়ে ৯ হাজার। সে ক্ষেত্রে মাস দুয়েক কম সময়ে মৌখিক পরীক্ষা শেষ করা যেত। সুপারিশ পাঠানো যেত সরকারের কাছে। হয়তো তারা ভেবেছিল, সরকার শূন্য পদের সংখ্যা আরও বাড়াবে। আর বাড়াতেও পারত। শূন্য পদ ও যোগ্য প্রার্থী যেখানে রয়েছে, সেখানে এটা করা অসংগত হতো না। জানা যায়, বিধিগত জটিলতার জন্য এ নিয়োগপর্ব থেকে এখনকার শূন্য পদের সব পদে নিয়োগ হচ্ছে না। ফলে আবারও আয়োজন করা আবশ্যক হবে এ ধরনের বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা।

সেটা যা–ই হোক, এবারে যাঁরা সুপারিশপ্রাপ্ত হবেন, তাঁদের নিয়োগপর্ব দ্রুত সম্পন্ন হোক, এটা সবাই চাইবেন। তবে চাওয়ার সঙ্গে কার্যক্রমের সংগতি থাকতে হবে। অনেক সরকারি মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সুতরাং ভাগ করে দিলে চার সপ্তাহে তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা সম্ভব। এটা মোটেই অসম্ভব নয়। হয়তোবা কাজের একটু চাপ বাড়বে। আগেও এমনটা হয়েছে। এরপর থাকছে স্বভাবচরিত্র–সংক্রান্ত প্রতিবেদন। এটা আগে শুধু পুলিশের বিশেষ শাখা করত। এখন জেলা প্রশাসকেরাও সমান্তরালভাবে এ কাজ করে থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে দায়িত্ব পায় কোনো কোনো গোয়েন্দা সংস্থা। যথেষ্ট যুক্তি ছাড়া সে তদন্তের পরিসরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। যেমন আগে দেখা হতো প্রার্থী রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত কিংবা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত কি না, এসব বিষয়াদি। এখন এর সঙ্গে দেখা হচ্ছে, প্রার্থী কিংবা তাঁর নিকটজন সরকারবিরোধী সংগঠনের সঙ্গে কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট কি না। এটাকেও অনুপযুক্ততা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। রাষ্ট্র আর সরকারকে আমরা একাকার করে ফেলেছি।

আর এ ধরনের তদন্ত একেবারে সুষ্ঠুভাবে হওয়াও সম্ভব নয়। স্থানীয় পর্যায়ের কিছুটা প্রভাবও এতে যুক্ত হয়। ফলে প্রতি বিসিএস থেকেই চূড়ান্ত সুপারিশের পর প্রায় ৭ থেকে ৮ শতাংশ বাদ পড়ে যায়। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধঘোষিত কোনো সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিংবা নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত বা অভিযুক্ত হলে কাউকে অবশ্যই বাদ দেওয়া যায়। অনেক কাল আগে থেকেই এমনটা চলে আসছিল। তবে স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর গণতন্ত্রায়ণের সময়ে দলীয়করণের যে ভূত আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রে চেপে বসেছে, তা থেকে আমরা কোনো অবস্থাতেই মুক্তি পাচ্ছি না। বরং ক্রমান্বয়ে বিষয়টি পাকাপোক্তই হচ্ছে।

জানা যায়, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ডাক্তারের পদই সৃষ্ট করা হয়নি। নচেৎ আরও ডাক্তার এ বিসিএস থেকেই নিয়োগ দেওয়া যেত। এ অব্যবস্থাও আমাদের সরকার ব্যবস্থায় স্থান করে নিয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প অনুসারে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হয়। এগুলো নির্মাণ করা হয় জনগণের স্বাস্থ্যসেবা দিতেই। আর তা করতে হলে নির্মাণের পরপরই দরকার হবে ডাক্তার, নার্সসহ অন্য কর্মীদের। আবশ্যক হবে আসবাবসহ সরঞ্জামাদি। সে জনবল ও সরঞ্জামাদিসংবলিত সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করতে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় ছাড়াও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগের সম্মতি এবং প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির সুপারিশ আবশ্যক হয়। ভারসাম্য রাখার জন্য এগুলোর প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করা যায় না।

তবে বিষয়গুলো এতটাই গতানুগতিক যে অতি অল্প সময়ে অনেকগুলো স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সাংগঠনিক কাঠামো অনুমোদন দেওয়া যায়। যেমন শয্যাভেদে হাসপাতালের জনবলকাঠামো অনেকটা এক। স্থানভেদে সামান্য তারতম্য থাকে। তাই নতুন কোনো ৫০ শয্যার হাসপাতাল হলে কিংবা ১০০ শয্যার হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় রূপান্তর করা হলে এর সাংগঠনিক কাঠামো অনুমোদনে তেমন একটা সময় লাগার কথা নয়। বারংবার নথি চালাচালিরও নেই তেমন আবশ্যকতা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা–ই হচ্ছে। এর জন্য কোনো রাজনীতিক বিন্দুমাত্র দায়ী নন। আর বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, এর দায়ভার নিরঙ্কুশভাবে প্রজাতন্ত্রের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদেরই। তাঁদের ত্বরিত ইতিবাচক পদক্ষেপ এ সময়ক্ষেপণ এড়াতে সহায়ক হয়।

প্রায়ই অভিযোগ হয়, ১০০ শয্যার হাসপাতালে থাকে ৩১ বা ৫০ শয্যার আর ২৫০ শয্যার হাসপাতালে থাকে ১০০ শয্যার জনবল। তর্কাতীতভাবে ব্যাহত হয় যথোচিত স্বাস্থ্যসেবা। অনেক শ্রমসাধ্য এমবিবিএস, বিডিএস ডিগ্রিধারী তরুণ–তরুণীদের থাকতে হয় বেকার বা অর্ধ বেকার। কেউ কেউ খুব কম মাইনেতে বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে সাময়িক কাজ নেন। জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে পদ আছে, কিন্তু মঞ্জুরি না থাকার জন্য ৩৯ তম বিসিএসে নিয়োগ পাবেন না ২ থেকে ৩ হাজার চিকিৎসক। যেটা ঘটে গেছে, তা বলে লাভ হবে না। তবে বিষয়গুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি কাম্য।

পরিশেষে ৩৯তম বিসিএসে চূড়ান্ত নিয়োগ প্রসঙ্গ। এখন যে ডাক্তাররা পিএসসির সুপারিশপ্রাপ্ত হবেন, তাঁদেরও সরকারি চাকরি পেতে স্বভাবচরিত্রগত প্রতিবেদন আবশ্যক। দরকার হবে স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদনও। সেটা দ্রুত করার হয়তো ব্যবস্থা হবে, কিন্তু স্বভাবচরিত্রগত প্রতিবেদনের জন্য যদি চলতি নিয়মে কাজ করা হয়, তবে তা অনেক সময় নেবে। অনেক লেখালেখির পরও এ সময়কাল কমানো যায়নি। তাই এ ক্ষেত্রে একমাত্র পথ থাকবে প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে নিয়োগ দেওয়া। এরূপ দেওয়ার বিধান আছে, অতীতেও হয়েছে। কারও বিরূপ প্রতিবেদন এলে স্বাভাবিকভাবে চাকরি চলে যাবে। তবে সে প্রতিবেদন প্রকৃতপক্ষে প্রার্থীর নিজের জন্যই সীমাবদ্ধ থাকুক। আর তা থাকুক রাষ্ট্রের স্বার্থ বিবেচনায়।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]