প্রবাসী বাঙালি প্রতিভার সন্ধানে

সেদিন এক তরুণ প্রতিভাবান ব্যক্তি প্রথম আলোর অফিসে এসেছিলেন শুধু এটুকু বলতে যে তিনি জাপানে এমন একটি গবেষণা করছেন, যার ফলাফল বাংলাদেশে প্রয়োগ করে তিনি মাতৃভূমির একটি বড় সমস্যার সমাধানে অবদান রাখতে চান। তাঁর নাম এম এল পলাশ, জাপানের কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। পরিবেশবান্ধব জ্বালানি (এনার্জি) বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে জাপানে অধ্যয়নরত কয়েকজন প্রতিভাবান শিক্ষার্থী।

এম এল পলাশের সঙ্গে এসেছিলেন ঢাকার পোশাকশিল্পের একজন তরুণ উদ্যোক্তা। কারণ, তাঁর কারখানায় পলাশ তাঁদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি প্রয়োগ করে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত (মডেল) দাঁড় করাতে চান। বিষয়টি হলো তাপশক্তির অপচয় রোধ করে সেই শক্তি ব্যবহার করে অন্য একটি শিল্পে কাজে লাগানো। এ জন্য তিনি এ দেশের পোশাকশিল্প কারখানা বেছে নিয়েছেন। প্রতিটি পোশাকশিল্প কারখানায় কাপড় ধোলাইয়ের ব্যবস্থা (লন্ড্রি) রাখতে হয়। কাপড় ধোয়া ও ইস্তিরির জন্য বাষ্প প্রয়োজন। এই বাষ্প তৈরি করা হয় বাষ্প চুল্লি বা স্টিম-বয়লারে। বয়লারে কিছু অতিরিক্ত তাপ তৈরি হয়, যা বাইরে বের করে দিতে হয়। বিজ্ঞানী পলাশ এই অব্যবহৃত বাষ্পীয় তাপ নষ্ট হতে না দিয়ে তা সংগ্রহ করে হিমাগারে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছেন।

এটা সম্ভব। হিমাগারে শীতলীকরণের জন্য বিশেষ যন্ত্র (চিলার) থাকে। চিলার চালানোর জন্য দরকার বিদ্যুৎ–শক্তি। এম এল পলাশ বিদ্যুতের পরিবর্তে স্টিম বয়লার থেকে বাইরে বের করে দেওয়া তাপ ব্যবহারের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে আমাদের দেশ দুভাবে লাভবান হবে। একদিকে বিদ্যুৎ বাঁচবে, অন্যদিকে এত দিন বয়লারের যে অতিরিক্ত বাষ্পশক্তি কাজে লাগানো যায়নি, সেটা কাজে লাগিয়ে বিরাট অপচয় বন্ধ করা যাবে। এম এল পলাশের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে দেশ উদ্ভাবনী দক্ষতায় বিশ্বে স্থান করে নেবে।

এ ধরনের উদ্যোগ অন্য কয়েকটি দেশেও বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু পলাশের উদ্যোগের নতুনত্ব হলো, এটা পরিত্যক্ত বাষ্পশক্তি ব্যবহার করে চিলারের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দেওয়া। এটা পরিবেশের জন্যও উপকার। আমাদের দেশে তো প্রচুর পোশাকশিল্পের কারখানা। আবার গ্রামে ইটভাটায়ও প্রচুর তাপশক্তির অপচয় হয়। তাই এম এল পলাশ চিন্তা করলেন আমাদের দেশে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এতে দেশের কল্যাণ হবে।

এম এল পলাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, ইলেকট্রনিকস ও কমিউনিকেশনস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে বিএসসি ও এমএসসি পাস করে পিএইচডি করতে জাপানে যান। সেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অনেক বাঙালি শিক্ষার্থী পিএইচডি করছেন। পলাশ বললেন, তাঁদের প্রায় সবাই পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসতে চান। দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে চান।

পলাশের মতো তরুণ উদ্যোগী বিলাত-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় প্রচুর আছেন। তাঁদের অনেকে উন্নত দেশগুলোতে অধ্যাপনা, গবেষণা বা বিশ্বসেরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁদের রয়েছে অনেক সাফল্য। তাঁদের অনেকে কিন্তু দেশে কাজ করে অবদান রাখতে চান।

আমরা অনেক সময় দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা ত্রুটি-অসংগতি দেখে হতাশ হই। ত্রুটি আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু সাফল্যের দিকটিও কম উজ্জ্বল নয়। পলাশের মতো এই যে হাজার হাজার তরুণ দেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বিদেশে গিয়ে সাফল্যের সঙ্গে পিএইচডি করছেন, নতুন নতুন গবেষণায় সাফল্য লাভ করছেন, তার ভিত্তি তো আমাদের দেশেই রচিত হয়েছে।

এই তরুণদের প্রতি আমাদের নজর দিতে হবে। আমরা তো জানিও না বাংলাদেশের কতজন তরুণ নাসায় কাজ করছেন, গুগল, ফেসবুক, আইবিএমসহ সিলিকন ভ্যালির কত প্রতিষ্ঠানে কত বাঙালি তরুণ উঁচু পদে কাজ করছেন। তাঁদের কত শত আবিষ্কার আমেরিকায় পেটেন্ট করে সুনাম অর্জন করেছে। তাঁরা প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন।

অথচ আমাদের দেশে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান উপযুক্ত দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী পায় না। তাই বিদেশ থেকে তারা কর্মী নিয়ে আসে। তাঁরা প্রতিবছর এখানে কাজ করার সুবাদে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যান। অথচ উপযুক্ত বেতন-ভাতা দিয়ে প্রবাসী বাঙালি বিজ্ঞানী, গবেষক, অধ্যাপক আমরা নিয়ে আসতে পারি। এতে আমাদের দেশের সন্তানেরা দেশেই অবদান রাখার সুযোগ পাবেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাও দেশেই থাকবে।

ধরা যাক, আমাদের কোনো কোম্পানি এমন একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিতে চায়, যিনি জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের শিল্পোদ্যোক্তাদের সঙ্গে দক্ষতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবেন এবং সর্বাধুনিক পদ্ধতির ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ব্যবহার করে কোম্পানি চালাতে পারবেন। এর জন্য তো জাপান-আমেরিকার কর্মী আনার দরকার নেই। আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ওই সব দেশে এখনই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন বা গবেষণায়-অধ্যাপনায় নিয়োজিত আছেন, এমন বাঙালি বিশেষজ্ঞের তো অভাব নেই। আমরা কেন তাঁদের খুঁজে বের করছি না? একজন বিদেশি বিশেষজ্ঞকে যদি আমরা ৫ হাজার ডলার বেতন, বছরে দুবার নিজ দেশে যাওয়া–আসার খরচ, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাবদ আরও কয়েক হাজার ডলার দিতে পারি, তাহলে একই দক্ষতার প্রবাসী বাঙালি বিশেষজ্ঞকে কেন পাঁচ-সাত লাখ টাকা বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নিয়োগ করতে পারব না? এতে দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদেরও কিছু খরচ কমবে, দেশও মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে পারবে।

সেদিন প্রথম আলোর এক গোলটেবিল বৈঠকে দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য একজন আলোচক প্রবাসী বাঙালি দক্ষ উদ্যোক্তাদের দেশে নিয়ে আসার তাগিদ দিয়ে বলেন, যদি তাঁদের বিদেশে এত দিন কাজের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ সহজে দেশে স্থানান্তরের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে দেশীয় দক্ষ কর্মীর অভাব হবে না। আগামী মাসে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের সময় এই দিকটি বিবেচনায় রাখা উচিত।

প্রতিভাবান প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ রাখলে আমাদের শিল্পপতিরা সহজে তাঁদের উপযুক্ত পদে নিয়োগ দিতে পারেন। এদিকে গুরুত্ব দিলে সুফল পাওয়া যাবে।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]