২৬ এপ্রিলের তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন

তাজউদ্দীন আহমদ ও জোহরা তাজউদ্দীন। ছবি পারিবারিক অ্যালবাম
তাজউদ্দীন আহমদ ও জোহরা তাজউদ্দীন। ছবি পারিবারিক অ্যালবাম

তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন (লিলি) ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য জুটি। একজন ধরেছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের হাল, অন্যজন চরম দুর্দিনে ধরেছিলেন আওয়ামী লীগের হাল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে রুখে দেশমুক্তির সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন আর অন্যজন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী চার জাতীয় নেতার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর সাহসিকতার সঙ্গে দলকে জিইয়ে রেখেছেন। দেশ ও দলের চরম সংকটকালে তাঁদের ওপর যখন নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হলো, তাঁরা দেশ, জাতি ও দলকে উজ্জীবিত করেছিলেন আশার আলো ও প্রেরণার বাতিঘর হয়ে। এ কারণেই তাঁদের না জানলে বাংলাদেশের জন্ম এবং রাজনৈতিক ইতিহাসকে সঠিকভাবে জানা ও বিশ্লেষণ করা সম্ভবপর নয়।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পুনর্জাগরণে এবং বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ ও জোহরা তাজউদ্দীনের ব্যক্তিগত জীবনেও এই এপ্রিল এক গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসেই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গঠন করেছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; সেক্টর কমান্ডারদের নিয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধরত সামরিক ও বেসামরিক দলগুলোকে একটি রাজনৈতিক সরকারের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করেছিলেন।

১৯৭৫ সালে পরিবারসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন নিজ বাসগৃহে। রাষ্ট্রের সূচনালগ্নের নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর তিন সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামারুজ্জামানকে কারাগারে হত্যা করা হয়। নেতৃত্বের চরম শূন্যতার সময় ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে এক ঘরোয়া বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে জোহরা তাজউদ্দীনের ওপর অর্পিত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। একজন সচেতন সমাজকর্মী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক রূপে দলটিকে পুনরুজ্জীবিত করেন। সে সময় জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকাল। গণহত্যাকারী ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি পুনঃ প্রতিষ্ঠিত। বাইরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ। আওয়ামী লীগের অন্য নেতা-কর্মীদের অনেকেই জেলে অথবা পলাতক। দলের এই চরম দুর্দিনে সামরিক শাসক আরোপিত প্রবল বাধা-নিষেধ ও হুমকির মধ্যেও জোহরা তাজউদ্দীন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া—রাস্তাঘাট ও বিদ্যুৎবিহীন দুর্গম এলাকাগুলো ভ্রমণ করে আওয়ামী লীগে প্রাণসঞ্চার করেন। নেতা–কর্মীদের উজ্জীবিত করেন। প্রচণ্ড সাহসী এই নারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং নিজ দলে শান্তি ও ঐক্য বজায় রাখতে যে ত্যাগ করেছিলেন, তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হওয়া আবশ্যক।

মনীষীরা বলেন, ‘একজন মানুষকে তার ব্যক্তিগত জীবন ও চরিত্রের মধ্য দিয়েই সত্যিকারের জানা যায়।’ ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখিয়েছেন সেই প্রতারক রাজনীতিবিদকে, যিনি বাইরে স্বদেশি করেন, খাদি পরেন আর তার পকেটে লুকায়িত থাকে বিলেতি সিগারেট। এই ধরনের নেতারাই দুর্যোগকালে পিছুটান দেন এবং ক্ষমতাপ্রাপ্তির জন্য অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেন। একজন রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব হলো তাঁর ব্যক্তি চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। সে জন্যই তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর সুযোগ্যা স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীনকে শুধু তাঁদের রাজনৈতিক অবদান দিয়ে মূল্যায়ন করা যাবে না। তাঁরা রাজনীতিতে যে সততা, ত্যাগ ও নীতি-আদর্শের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে।

তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা খাতুন লিলির বিয়ে উপলক্ষে প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৫৯ সালের ১৪ এপ্রিল, বাংলা নববর্ষে। সেদিনের আলাপের পর লিলি বলেছিলেন যে তিনি সোনার গয়না পছন্দ করেন না। বেলি ফুল ভালোবাসেন, সেই ফুল দিয়েই তাঁর বিয়ে হোক, এই তাঁর ইচ্ছা।

১৯৫৯ সালের ২৬ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা খাতুন লিলির বিয়ে হয়। লিলির ইচ্ছা অনুসারে বিয়েতে তাজউদ্দীন তাঁকে একরাশ বেলি ফুলের গয়না দিয়ে বরণ করেন। এই নির্লোভ ও মহৎ আদর্শের ভিত্তির ওপর তাঁদের যে দাম্পত্য জীবন শুরু হয়েছিল, তা কালের নানা চড়াই–উতরাইয়ের পরশমণির ছোঁয়ায় পূর্ণতা লাভ করে। দেশমুক্তির পণ নিয়ে দুর্গম পথে যাত্রার সময়, একটি চিরকুটে তাজউদ্দীন স্ত্রীকে লিখেছিলেন, ‘লিলি আমি চলে গেলাম। যাওয়ার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিয়ো। আবার কবে দেখা হবে জানি না...মুক্তির পর। ছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে মিশে যেও। দোলন চাঁপা।’ বঙ্গতাজের ছদ্মনাম। স্বামীর বার্তাটি পড়ে তাঁর কী অনুভূতি হয়েছিল সে বিষয়ে জোহরা লেখেন, ‘কতক্ষণ যে কাগজখানা নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম জানি না। সেদিনের সেই মুহূর্তে এ কথা কয়টি কথার কথাই ছিল না। জীবনের পরবর্তী অধ্যায় শুরু করার জন্য সেই লেখাগুলি ছিল পবিত্র প্রেরণার উৎস। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে নিজেকে নতুনভাবে নতুন রূপে আবিষ্কার করেছিলাম সেদিন।’

পাকিস্তানি মিলিটারির তাড়া খেয়ে, নাবালক চার ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর ঘুরে মে মাসের শেষে জোহরা যখন ভারতে গেলেন, তখন গভীর রাতে কয়েক মিনিটের জন্য দেখা হলো স্বামীর সঙ্গে। কলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হোসেন আলীর গৃহে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ জোহরাকে তাজউদ্দীন জানালেন যে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন দেশ যত দিন স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে মুক্তি না লাভ করবে, তিনি তত দিন পারিবারিক জীবনযাপন করবেন না। যুদ্ধাবস্থায় মুক্তিসেনারা যদি পরিবার ছেড়ে রণাঙ্গনে যেতে পারেন, তিনি তাঁদের প্রধানমন্ত্রী হয়ে কেন পারবেন না। তাজউদ্দীনের কথা শুনে জোহরা তাঁর মনের অনুভূতি (এই লেখকের কাছে সাক্ষাৎকার, ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৯৩) ব্যক্ত করেছিলেন, ‘সেই মুহূর্তগুলোতে এমন গৌরবমণ্ডিত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে আমি প্রাণভরে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে নয়, দারুণ শিহরণ জাগানো ঐকমত্য পোষণ করেছিলাম উদ্ভাসিত গভীর দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে। তিনি বুঝেছিলেন। তারপর তিনি চলে গেলেন। সেই সময়কার ওই মহান সিদ্ধান্ত হাজার বছরের যেন এক অমূল্য উপাদান। চলন্ত জীবনের কত ঐতিহাসিক ঘটনার উত্থান-পতনের সঙ্গে বারবার তাঁকে আবিষ্কার করেছি, ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর পরিসরে। এ যে কত বড় অমূল্য সাধনার প্রাপ্তি!’

ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও দশকে ভালোবাসার কী অমূল্য আদর্শ রেখে গেলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আর জোহরা তাজউদ্দীন কত নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে একাত্ম করে দিলেন তাঁর জীবনসাথির মহৎ সংগ্রামের অনুচ্চারিত প্রেরণা হয়ে।

২৬ এপ্রিল তাঁদের ৬০তম বিবাহবার্ষিকীতে প্রার্থনা করি তাঁদের মতো আলোকিত আরও নতুন মানুষের।

শারমিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের জ্যেষ্ঠ কন্যা