ভাগালু-দাওয়ালরা ভাগল কোথায়?

জেলখানায় বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখা ডায়েরিতে (অসমাপ্ত আত্মজীবনী—শেখ মুজিবুর রহমান, দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ ২০১২, পৃষ্ঠা ১০৩-১০৫ দেখুন) ধান কাটার শ্রমিকদের প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘...ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার লোক খুলনা বরিশালে ধান কাটবার মরশুমে দল বেঁধে দিনমজুর হিসাবে যেত। এরা ধান কেটে ঘরে উঠিয়ে দিত। এদের “দাওয়াল” বলা হতো। এমনিভাবে কুমিল্লা জেলার দাওয়ালরা সিলেট জেলায় যেত...।’ বঙ্গবন্ধু যাঁদের ‘দাওয়াল’ বলেছেন, হাওর অঞ্চলে তাঁরা কালে কালে ‘ভাগালু’ আর তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় খেতমালিকদের যোগাযোগকারীরা ‘ব্যাপারী’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, ‘...এরা না গেলে জমির ধান তুলবার উপায় থাকে না। এক সঙ্গেই প্রায় সব ধান পেকে যায়, তাই তাড়াতাড়ি কেটে আনতে হয়। স্থানীয়ভাবে এত কিষান এক সাথে পাওয়া কষ্টকর। বহু বৎসর যাবৎ এই পদ্ধতি চলে আসছিল...।’ এই পরিস্থিতি এখনো বিরাজমান।

নানা স্থানীয় ও জাতীয় উদ্যোগের কারণে কোনো কোনো অঞ্চলে সাধারণ মানুষের আয়-রোজগারের বিকল্প ও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় দিন দিন তাঁদের ধান কাটতে হাওরে যাওয়ার আগ্রহ কমেছে। ষাটের দশক থেকেই কুমিল্লা জেলার লোক আয়-রোজগারের বিকল্প পথের দিশা পান। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরের একফসলি বিল এলাকায় তিন ফসলের আবাদ শুরু হওয়ায় জীবিকার জন্য এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ছোটাছুটির চাপ কমে যায়। তাঁদের শূন্যস্থান পূর্ণ করতে বন্যা, নদীভাঙন আর জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে দিশেহারা অঞ্চলের খেটে খাওয়া লোকজন এগিয়ে আসেন। হাওরপারের বসতিদের সূত্রে জানা যায়, আশির দশকে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর, জামালগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলার মাটিয়ান হাওর, আলী হাওরসহ বড় বড় হাওরে বোরো ধান কাটতে শ্রমিক আসতেন ফরিদপুর ও মাদারীপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে।

নব্বইয়ের দশকের দিকে ওই সব অঞ্চল থেকে ধান কাটা শ্রমিকেরা আর আসেন না সুনামগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলের উপজেলাগুলোতে। সে সময় থেকে কিছু শ্রমিক আসতে শুরু করেন জামালপুর, গাইবান্ধা, রংপুর, ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া ও নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা উপজেলা থেকে। সিডর-আইলার পর খুলনার দাকোপ, বাগেরহাটের শরণখোলা অঞ্চলের লোক যোগ দেন হাওরের ধান কাটা শ্রমিকের দলে।

কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে ওই সব এলাকার শ্রমিকেরা আর তেমন আসছেন না হাওরে ধান কাটতে। ফলে হাওরপারের কৃষক বাধ্য হয়ে উপজেলার ভেতরের বিভিন্ন গ্রাম ও আশপাশের উপজেলা থেকে ধান কাটার শ্রমিক সংগ্রহের চেষ্টা করে থাকেন। তবে ২০১৭ সালের হাওর বিপর্যয়ের পর স্থানীয় শ্রমিকদের সংখ্যাও কমতে থাকে। বর্তমানে ধান কাটা শ্রমিকের সংকটে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন হাওরপারের কৃষক।

কেন এই সংকট

কেউ কি বিষয়টি নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সংকটের হদিস পাওয়ার চেষ্টা করেছেন? সরকারি-বেসরকারি কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কোনো বিভাগ এ রকমের একটা খাদ্যনিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কিছু ভাবছে? সবাই যে যার ধারণা আর শোনা কথার ওপর নির্ভর করে কারণ বাতলাচ্ছে। সমাধানের ছোট পথ খুঁজছে। মূল কারণ খুঁজে দেখার চেষ্টা করছে না।

কেন দেশের অন্য অঞ্চলের বেকার অভাবী মানুষ আগের মতো নৌকা নিয়ে দল বেঁধে ধান কাটার উৎসবে শামিল হচ্ছে না? কী তার কারণ?

বঙ্গবন্ধু-বর্ণিত নদীপথের সহজ ও সস্তা যোগাযোগব্যবস্থা কি পুরোপুরি বিলুপ্ত?

সড়কপথে যাতায়াত কি এখন অনেক খরচের আর ঝুঁকির?

মজুরি হিসেবে পাওয়া ধান শ্রমিকের জেলায় নিয়ে যাওয়ার খরচ (ট্রাক ভাড়া, পথ ‘পুলিশের সম্মানী’ আর পরিবহন শ্রমিক সমিতির চাঁদা ইত্যাদি) কি খুব বেড়ে গেছে?

হাওরে কি বজ্রপাতের ঝুঁকিতে শ্রমিকেরা ভীত?

নানা ধরনের রোগবালাই দেখা দেওয়ায় বিঘাপ্রতি ধানের ফলন খালি চোখে ঠাওর (আন্দাজ) করতে না পেরে শ্রমিক ঠকছেন, তিনি তাঁর আন্দাজমতো ধান পাচ্ছেন না, কিন্তু তাঁকে ধানগাছ কাটতে হচ্ছে সবটা।

নাকি কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় সবার অলক্ষ্যে এমন কোনো পরিবর্তন ঘটেছে, যা পুরোনো ব্যবস্থাকে আর ধারণ করতে পারছে না? (এখন জমি চাষের জন্য কথিত জমির মালিককে নগদে আগাম টাকা দিয়ে দিতে হয় ভাগচাষিকে। ধান কাটার পর উৎপাদিত ধানের ওপর ভাগ-বণ্টন প্রথা এখন আর নেই, ফলে প্রকৃত চাষির পক্ষে ভাগালুর সঙ্গে দর-কষাকষির ক্ষেত্রে তাঁর হাত-পা এখন অদৃশ্য শিকলে বাঁধা)।

এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে না পেলে সমাধান থাকবে অধরা।

এখন সমাধান কী

জেলা প্রশাসন একটা আপাতসমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছে। সুনামগঞ্জের আশপাশের সব পাথর কোয়ারি ধান কাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হুকুম জারি করেছে। পুলিশ আর সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে এই আদেশ প্রতিপালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাথর কোয়ারির সাত হাজার শ্রমিককে ধান কাটার কাজে যুক্ত করার লক্ষ্যে এই আয়োজন। কে পাথর ভাঙবেন আর কে ধান কাটবেন, সেটা কি নীলকরদের মতো আমরা ঠিক করে দিতে পারি? মজুরি যেখানে বেশি খোলাবাজার অর্থনীতিতে, মানুষ সেখানেই ছুটে যাবে। বাজার কি শুধু ‘জগৎশেঠ, রায়বল্লভ, রাজা আর দরবেশ’দের জন্য খোলা থাকবে আর শ্রমিকেরা
কাজ করবেন কোম্পানির নীলকরদের অধীনে ক্রীতদাসের আইনে। পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকলে শুধু কি সাত হাজার শ্রমিকের কাজ বন্ধ থাকবে? পাথর উৎপাদন, পরিবহন, কেনাবেচা আর ব্যবহারের সঙ্গে যে আরও লাখো মানুষের রুটিরুজি বন্ধ হয়ে যাবে, তার দায়িত্ব কে নেবে? প্রশাসন শবে বরাতের পর নিজেরাই ভাগালু সাজবে বলেছে। ২৩ তারিখ থেকে তারা ধান কাটার উৎসবের আয়োজন করবে। আশা করি, সেটা ক্যামেরা-সেলফির কাজ শেষ হলেও চলতে থাকবে।

ফসল বোনা আর কাটার সময় মা-বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করার চল এ দেশেও বহুদিনের। এ কারণেই পৃথিবীর বহু দেশে স্কুল আর পরীক্ষার দিনক্ষণ ঠিক করা হয় চাষবাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। আমাদের দেশেও কাগজে এ রকম একটা ব্যবস্থার কথা বলা আছে। হাওরপারের মা-বাবা যখন ভাগালুর অভাবে ধান নিয়ে বিপাকে, তখন তাঁদের ১৪ হাজার ৫৩৪ জন ছেলেমেয়ে এইচএসসি পরীক্ষার হলে বন্দী। একটু চিন্তা করে তাদের পরীক্ষাটা এক মাস আগে শেষ করতে পারলে কম করে হলেও এর অর্ধেক ছেলেমেয়ে মা-বাবাকে ধান তোলার কাজে সাহায্য করতে পারত। ধানের উৎপাদন আর বাজার পাওয়ার সঙ্গে এসব ছেলেমেয়ের পরবর্তী পড়াশোনা নির্ভর করবে। সময়মতো ধান লাগাতে আর কাটতে পারে না বলেই কি লেখাপড়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে থাকছে সুনামগঞ্জ?

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]