বাংলাদেশ নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে পারে না

বাঙালি প্রবচনে পারদর্শী। তবে তার সব প্রবচনের মর্মার্থ বাস্তবসম্মত নয়। যেমন চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। চোর চুরি করে মালামাল নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর যে ভবিষ্যতে চুরি ঠেকানোর মতো বুদ্ধি বের হবে বাড়ির মালিকের মাথা থেকে, তা বলা যায় না। প্রকৃত বুদ্ধিমান সব সময়ই সাবধানতা অবলম্বন করে। তবে তার পরেও অঘটন ঘটতে পারে।

পৃথিবীর এক ইঞ্চি জায়গাও আজ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ঝুঁকিমুক্ত নয়। বহু ঘটনা পৃথিবীর দেশে দেশে ঘটছে। ছোটখাটো ঘটনার খবর বিশ্ববাসী জানে না। আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে তা আসে না। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের মসজিদে এবং শ্রীলঙ্কার গির্জা-হোটেলের সন্ত্রাসী ঘটনা বিশ্ববিবেককে আলোড়িত করেছে। শ্রীলঙ্কার ঘটনার দিনই নাইজেরিয়ায় ১০-১২ জন সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন, সে সংবাদ চাপা পড়ে যায়।

শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিয়ে সব সময় উদ্বিগ্ন থাকি। নিউজিল্যান্ডের মতো শান্তিপূর্ণ একটা দেশ, যেখানে পুলিশও ব্যবহার করা লাগে না, ওই রকম একটা দেশে সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটতে পারে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সজাগ আছে। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছি।

ধর্মীয় জঙ্গিবাদ, বিশেষ করে ইসলামি জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সাফল্য পৃথিবীর বহু দেশের চেয়ে বেশি। সন্ত্রাসবাদের কোনো ধর্ম নেই জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিউজিল্যান্ডে কী হলো! একজন মাথায় ক্যামেরা লাগিয়ে গুলি করার মুহূর্ত সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে দিচ্ছে। কী বীভৎস মানসিকতা। সে একজন খ্রিষ্টান। আর শ্রীলঙ্কায় যারা শনাক্ত হয়েছে, তারা মুসলমান। জঙ্গিবাদ শুধু মুসলমানরা করে না। খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দুধর্মেও আছে। এটা কোনো ধর্মীয় বিষয় নয়।’ [প্রথম আলো]

জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ মোটেই ধর্মীয় বিষয় নয়, কিন্তু বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী অতি অল্প কিছু উগ্র ও অশুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সন্ত্রাসবাদে লিপ্ত। এবং সেই গুটিকয় মানুষের সহিংস কর্মকাণ্ডে উদ্বিগ্ন ও বিপন্ন ৯৯ ভাগ মানুষ। নিউজিল্যান্ডের মসজিদে যিনি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে আক্রান্ত মানুষের কারোরই শত্রুতা তো নয়ই, পরিচয় পর্যন্ত ছিল না। শ্রীলঙ্কায় যাঁরা রক্তপাত ঘটিয়েছেন, তাঁদের কারও সঙ্গে নিহত ব্যক্তিদের চেনা-পরিচয় পর্যন্ত ছিল না, বৈরিতার প্রশ্নই আসে না। তা হলে কেন এই নিষ্ঠুরতা ও আদিম বর্বরতা। সংবেদনশীল মানুষও পৃথিবীতে কম নেই। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, তাঁর সরকার এবং সে দেশের মানুষের ভূমিকাও বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা না থাকলেও ঝুঁকি রয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে রোববার থেকে গণসংযোগ শুরু করেছে। ডিএমপির ৫০টি থানায় এই কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে স্কুল-কলেজসহ নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া চিঠি দিয়েছেন।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম শনিবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক ঝুঁকির প্রেক্ষিতে আমাদের দেশ ঝুঁকিতে থাকলেও কোনো হামলার আশঙ্কা নেই। দেশে কোনো হুমকি বা হামলার তথ্য এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে নেই।’ তিনি বলেন, ‘ইতিপূর্বে আমাদের বিভিন্ন অভিযানে তাদের [জঙ্গিবাদীদের] সাংগঠনিক সক্ষমতা অনেকটা ভেঙে গেছে। তবে শ্রীলঙ্কায় হামলার ঘটনার পর থেকে নিঃসন্দেহে তারা ইন্সপায়ার (অনুপ্রাণিত) হয়েছে। তবে হামলার জন্য সাংগঠনিক কাঠামো, মনোবল ও সরঞ্জাম তাদের নেই। হামলার জন্য যে পরিমাণ সরঞ্জামের প্রয়োজন, সেগুলো জোগাড় করা অনেক সময়ের ব্যাপার।’ [যায়যায়দিন, ২৮ এপ্রিল]

সব দেশেরই গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথাগত সন্ত্রাস ও জঙ্গি হামলা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। হিংসার অপ্রথাগত উন্মত্ত প্রকাশ কীভাবে, কোথায়, কখন ঘটবে, তা অন্তর্যামী ছাড়া পৃথিবীর কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই শান্তিপূর্ণ বলে কথিত নরওয়ে, সুইডেনের মতো দেশে ঘটে, নেদারল্যান্ডসে ঘটে, ফ্রান্সে ঘটে, স্পেনে ঘটে। সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে এখন আর প্রথাগত বন্দুক, স্টেনগান, বোমা, গ্রেনেডের দরকার নেই। একদা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ফ্রান্সের সুদক্ষ পুলিশ জানত না জনতার ওপরে ট্রাক উঠিয়ে দিয়েও মানুষ হত্যা করা যায়।

জঙ্গি হামলার শিকার কে হবে, তা–ও আগাম আঁচ করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। কখন কোন হামলায় নিরপরাধ পথিক, প্রার্থনারত মানুষ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিষ্পাপ শিশু-কিশোর প্রাণ হারাবে, তা কেউ জানে না। হোলি আর্টিজানের ঘটনায় লতিফুর রহমানের নাতি নিহত ফারাজ আইয়াজ হোসেনের সঙ্গে দুনিয়ার কারও শত্রুতা ছিল না। শ্রীলঙ্কায় বেড়াতে গিয়ে শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি শিশু জায়ান চৌধুরীর প্রাণহীন দেহ ফিরে এল। শত্রুতা কাকে বলে, সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ কী, সে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। লামায় যারা আগুন দিয়ে ছারখার করেছিল, তাদের সঙ্গে সেখানকার বৌদ্ধধর্মাবলম্বী একজন নারী-পুরুষেরও শত্রুতা ছিল না।

অনেক দেশেরই কিছু নিজস্ব সমস্যা থাকে, তা থেকে হিংসাশ্রয়ী কর্মকাণ্ড ঘটে থাকে। সেসব সন্ত্রাসী কাজে সব পক্ষই একটা যুক্তি ও নৈতিক ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। তামিল টাইগার্সদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনীর দীর্ঘ সংঘর্ষে যে রক্তপাত, তা জাতিগত ও রাজনৈতিক সংঘাত। তার অবসান হয়েছে। ইসলামি মৌলবাদ সারা দুনিয়ায় কমবেশি আছে, শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু মুসলমানদের কারও কারও মধ্যে মৌলবাদী থাকবে, ধর্মান্ধতা থাকা সম্ভব। সেখানকার উগ্র বৌদ্ধ মৌলবাদ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম থেকে জানা যায়। হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিষ্টানরা তাদের আক্রমণের শিকার। এবারের বর্বরতার কারণ ভিন্ন। কোন সুদূর সমুদ্রের ভেতর দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড, সেখানকার ঘটনার প্রতিক্রিয়া আরেক ছোট দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায়। এই দুই ঘটনায় দুই রাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক নেই, দুই দেশের জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই: মূল কারণ হিংসা ও প্রতিহিংসা।

অনেক দেশেই সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। মিয়ানমারও সামরিক কর্মকর্তাদের শাসনাধীনে আছে বহুকাল। কিন্তু মিয়ানমারের সেনাশাসকেরা অতি উগ্র বৌদ্ধ মৌলবাদী। সে দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত নিপীড়নের লোমহর্ষক কাহিনি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ ও সন্দর্ভ। মানবেতিহাসের বর্বরতম নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে লাখ লাখরোহিঙ্গা। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক, কিন্তু তাদের অপরাধ দুটি: ধর্মে তারা মুসলমান এবং মুখের ভাষা তাদের বাংলা। মানবিক কারণে শেখ হাসিনার সরকার তাদের আশ্রয় দিয়েছে। তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব একা বাংলাদেশের নয়। নির্যাতিত মানুষেরা সন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে, সে আশঙ্কা ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জঙ্গিবাদ রোধ করতে সব দেশের জোরালো ভূমিকা প্রত্যাশিত। তিনি বলেছেন, ভারত, রাশিয়া, জাপান ও চীন চায় রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হোক, কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের জোরালো ভূমিকা নেই।

সম্প্রতি ব্রাসেলসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নিরাপত্তাহীনতা তথা জঙ্গিবাদকে উসকে দিতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশ নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে পারে না।

জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে হলে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মানুষের মন থেকে হিংসা দূর করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের মধ্যপ্রাচ্যের নিবর্তনমূলক নীতির পরিবর্তন ছাড়া শান্তিপূর্ণ বিশ্ব আশা করা যায় না। প্রবলের দ্বারা দুর্বলকে নির্যাতনের প্রবণতার কারণেই দুর্বলের মধ্যে হিংসার জন্ম হয়। প্রবল যদি সংযত না হয়, দুর্বলকে সংযত ও অহিংস হতে বলা যায় না নৈতিক কারণেই। বাংলাদেশ সন্ত্রাসী হামলা থেকে ঝুঁকিমুক্ত নয়। সর্বোচ্চ সাবধানতা কাম্য।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক