প্রচণ্ড গরম, অবস্থা চরম

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বাংলাদেশের মানুষ কী নিয়ে উত্তেজিত, ভাবিত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ক্ষুব্ধ, প্রসন্ন, তা জানার একটা সহজ উপায় হলো ফেসবুকে কিছুক্ষণ থাকা। আমাদের দেশে বিষয়ের অভাব হয় না। একেকটা বিষয় আসে, তখন মনে হয়, এইটাই পৃথিবীর সবচেয়ে জ্বলন্ত ইস্যু, এটার সমাধান না করে আমরা ছাড়ছিই না। কিছুদিনের মধ্যেই তার চেয়ে জ্বলন্ত আরেকটা বিষয় এসে পড়ে, তখন আমরা আগেরটা ভুলে যাই। ভাগ্যিস ভুলে যাই, তা না হলে আমরা ঘুমাতাম কী করে!
বাংলাদেশে এই রকম দিন খুব কম আসে, যখন আমরা মেঘ, বৃষ্টি, রংধনু, কৃষ্ণচূড়া, বিরহ, কবিতা, চিত্রকলা, চলচ্চিত্রের মতো বিষয়গুলো নিয়ে একেকজন একেক রকমের কথা বলতে পারি ফেসবুক স্ট্যাটাসে। কারণ, ঘটনাবিহীন কোনো দিন এখানে যায় না এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘটনা মানে দুর্ঘটনা।
বরং গত দুই দিন দেখছি, ফেসবুকে একটা নতুন হাওয়া বইছে: গরম নিয়ে নিজের নাম ধরে দুই লাইনের ছড়ার মতো রচনা করা। এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, গত দুই দিনে বাংলাদেশকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটেনি।
একদম ঘটেনি, তা অবশ্য নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জার্সি নিয়ে ফেসবুকাররা প্রবলভাবে আপত্তি তুলেছিলেন। সেই আপত্তি এতই প্রবল যে বিসিবি সভাপতি ঘোষণা করেছেন, জার্সির ডিজাইন বদল করার জন্য আইসিসিকে জানানো হচ্ছে। ফেসবুকাররা বীরদর্পে কি-বোর্ড থেকে হাত ফিরিয়ে নিয়েছেন, পরস্পরকে এবং নিজেকে অভিনন্দিত করছেন বিজয় ছিনিয়ে আনার শুভ উপলক্ষটিকে উদ্‌যাপন করতে।
তবে নিজের নাম নিয়ে দুই লাইনের ছড়াটা ভেতরে-ভেতরে বেশ চলছে।
আমি এটা করতে দেখেছি সবার আগে বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্ণধার গাওসুল আলম শাওনকে। নিশ্চয়ই তাঁরও আগে এটা কেউ না কেউ চালু করেছেন। শাওন লিখেছিলেন:
আমার নাম শাওন
এই গরমে কই যে যাওন??!!
ওই স্ট্যাটাসের নিচে কমেন্টসগুলো মজার।
ঈশিতা আজাদ লিখেছেন:
অল ইওর ফল্ট, শাওন তুমি বর্ষিবে কবে!
পলাশ মাহবুব নিজে ছড়াকার, তিনি মন্তব্য করলেন:
আপনার নাম শাওন,
গরমে কমান খাওন।
ছড়াকার ছড়া লিখলে উৎকৃষ্টতর হবে, সন্দেহ কী।
আর আমাদের আরেক বন্ধু ফারহানা আলম লিখলেন:
আমি ফারহানা, গরমে ডরাই না।
ফারহানার ডাকনাম স্বর্ণা। তাঁকে বললাম, লিখুন:
আমার নাম স্বর্ণা,
বৃষ্টি এসে পড় না।
তিনি সেটা লিখলেন।
তখন জ ই মামুন, এটিএন বাংলার দুঁদে সাংবাদিক, লিখলেন:
আমার নাম মামুন
তাপমাত্রা থামুন
বৃষ্টি এবার নামুন।
এখন আমি নিজে পিছিয়ে থাকি কী করে? প্রথমে লিখলাম:
তোর নাম কি আনিস?
গরম কী তা জানিস?
পরে ভাবলাম, পিছিয়ে পড়লাম নাকি। আবার লিখলাম,
আমার নাম আনিসুল,
গরমে আমি টানি চুল।
নিজের চুল নিজেই টানছি, এমন একটা সেলফিও লাগিয়ে দিলাম।
মধ্যরাতে দেখি, আমার সহকর্মী কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ স্ট্যাটাস দিয়েছেন:
আজ রাতে আমি মারা গেলে তার জন্য দায়ী থাকবে ‘গরম’।
কবি হয়ে মিল বা অন্ত্যানুপ্রাস ছাড়া আলতাফ এটা কী লিখলেন? কাজেই আমি মন্তব্যের ঘরে লিখলাম:
মিলল না তো আলতাফ!
বলো:
আমার নাম আলতাফ শাহনেওয়াজ
গরমই থাকবে দায়ী যদি মরি আমি রাতে আজ।
আলতাফ শাহনেওয়াজ সেটা ফেসবুকে দিলেন।
তারপর ঘটনা আরও গুরুতর হয়ে উঠল। দুজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবি, কামাল চৌধুরী আর মারুফ রায়হান দেখি আলোচনা করছেন, এই দুই পদে ছন্দ ঠিক আছে নাকি নাই! আমি বলি, আমি মাফ চাই। মিলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, ছন্দের দিকে নয়।
আপনারা ভাবছেন, প্রথম আলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাগজের খুবই দামি জায়গায় এই রকম হালকা একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছি কেন? পৃথিবী থেকে সমস্যা কি সব উঠে গেল?
এর উত্তরে আমি বলব, সমস্যা সব উঠে যায়নি। আমরা এমন একটা পৃথিবী চাই, সমাজ চাই, দেশ চাই, যেখানে কোনো সমস্যা থাকবে না, মানুষ মানুষকে শোষণ করবে না, হত্যা করবে না; একটা সাম্যসুন্দর আনন্দপূর্ণ সুখী গ্রহ হবে আমাদের এই পৃথিবী। তখন আমরা কী করব? কবিতা নিয়ে কথা বলব, গোলাপ নিয়ে কথা বলব, আশ্চর্য মেঘদল নিয়ে কথা বলব। তো, সেই পৃথিবী যত দিন না আসছে, তত দিন আমরা কি কেবল সমস্যা আর সমাধান নিয়েই কথা বলব?
দুটো দিন এসেছে, যখন আমরা রেপ, সড়ক দুর্ঘটনা, জঙ্গি হামলা, গুম, ক্রসফায়ার, ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্র, মির্জা ফখরুলের বাইরে গরম নিয়ে কথা বলতে পারছি। বলতে দিন না! রবীন্দ্রনাথ ‘বাজে কথা’ প্রবন্ধে বাজে কথার উপকারিতা নিয়ে তো সেই কবেই বলে গেছেন! শুধু কাজের কথা আর কাজের মানুষ দিয়ে পৃথিবী ভরে থাকলে সেটা খুব একটা বসবাস-অযোগ্য পৃথিবী হবে।
এখন বরং গরম নিয়ে বলি। আমাদের ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। মাথার ওপরে টিনের চাল। তবু গরমকালে গ্রামের বাড়িতে যেতাম। আম-কাঁঠালের ছুটিতে। একবার চৈত্র মাসে কুড়ি মাইল হেঁটে আমি আর আমার মামাতো ভাই দুপুরবেলা নানাবাড়ি থেকে দাদাবাড়ি গিয়েছিলাম। মরে যাইনি তো! এই গরমে আমরা যখন ছড়া লিখছি, তখনো কাচের কারখানায় গনগনে আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন শ্রমিকেরা, ইটের ভাটায় জ্বালানি ঠেলছেন শ্রমিকেরা, মাটিকাটা শ্রমিকেরা মাটি কেটে চলেছেন, দুই মণি বস্তা টানছেন কুলিরা, মাথায় করে; রিকশাওয়ালারা রিকশা টানছেন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাস্তবতা। শ্রমিকেরা গরমে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে পারছেন না, তার আগেই বাষ্প
হয়ে যাচ্ছে ঘামগুলো! সে-ও বাস্তবতা। একদিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষকে এই সব বিপজ্জনক কায়িক শ্রমের হাত থেকে বাঁচাবে, এ রকম সম্ভাবনা আছে। কিন্তু পৃথিবীর সব সম্পদ ১ ভাগ লোকের কুক্ষিগত হলে ৯৯ ভাগ লোকের ভালো হবে না খারাপ হবে, বলতে তো পারছি না।
যা-ই হোক, কাল-পরশু বৃষ্টিপাত হবে বলে মনে হচ্ছে। সাইক্লোন ফণী আসছে। এটাকে মনে করা হচ্ছে সাম্প্রতিক কালের ভয়ংকরতম। আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি নিতে হবে। সর্বোচ্চ সতর্কতাই এখন কাম্য।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক