ঘূর্ণিঝড় ফণীর বার্তা

ঘূর্ণিঝড় ফণী ভারতের ওডিশায় আঘাত হানার পর দুর্বল হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার ফলে আমরা এক বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেলাম, এটা নিঃসন্দেহে স্বস্তির বিষয়। ঘূর্ণিঝড়টি বেশ শক্তি নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং সেই বিবেচনা থেকে বেশ উদ্যোগ ও প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আবহাওয়া বিভাগের ধারণা অনুযায়ী সেই শক্তি নিয়ে আমাদের দেশে আঘাত হানলে যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো, তা কীভাবে মোকাবিলা করা যেত, সে চিত্রটি আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।

কারণ ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে ফণী শেষ পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি, প্রবেশ করেছে অনেকটা ঝোড়ো বাতাস হয়ে, কিন্তু তাতেই ৯ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। অথচ যে ওডিশায় ঘূর্ণিঝড়টি তার পূর্ণ শক্তিতে আঘাত হেনেছে, সেখানে মৃতের সংখ্যা ৮ বলে জানা গেছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ অতীতে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা অনেক দেশ বিবেচনায় নিচ্ছে। ওডিশায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশের মডেল কাজে লাগানো হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের সূত্রে আমরা জেনেছি। ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের যা অগ্রগতি ও সাফল্য, তাতে আত্মতৃপ্ত হয়ে সেখানে আটকে থাকার সুযোগ নেই। ঘূর্ণিঝড় ফণী আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে আরও উন্নত ও আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

ফণীর কারণে বড় জলোচ্ছ্বাসও আসেনি, কিন্তু পটুয়াখালী, বরগুনাসহ কিছু এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কয়েকটি গ্রাম জলমগ্ন হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। গতকাল দুপুরে এই সম্পাদকীয় লেখার সময় পর্যন্ত খুলনার কয়রা উপজেলায় একটি বেড়িবাঁধ গ্রামবাসী প্রাণপণে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কারণ সেটি ভেঙে গেলে অন্তত তিনটি গ্রাম পানিতে ভেসে যাবে। এই ঘূর্ণিঝড়ের বদৌলতে স্পষ্ট হয়ে উঠল, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলোর অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে, কিংবা সেগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী করে নির্মাণ করা হয়নি। বাংলাদেশে বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ বহুল উচ্চারিত। দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় সুরক্ষার জন্য যে বেড়িবাঁধগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কতটা দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা এখন অবশ্যই খতিয়ে দেখতে একটা সমীক্ষা চালানো প্রয়োজন। যেসব বাঁধ চিকন ও দুর্বল হয়েছে, জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর অবস্থায় আর নেই, সেগুলো ভালোভাবে মেরামত করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ফণীর ধ্বংসক্ষমতা ও তার সঙ্গে সম্ভাব্য জলোচ্ছ্বাসের বিপদ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা ছিল বলে মনে হয় না। এর জন্য প্রথমত ঘূর্ণিঝড়ের সংকেতব্যবস্থা ও সতর্কবার্তা প্রচারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা দায়ী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে গতানুগতিক টেকনিক্যাল ভাষায় ঘূর্ণিঝড়ের গতি–প্রকৃতিসহ আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রচার করা হয়, তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বোধগম্য নয়। বৈজ্ঞানিক পরিভাষা-কণ্টকিত আবহাওয়ার পূর্বাভাস শুনে বা পড়ে এমনকি শিক্ষিত নাগরিকদের পক্ষেও সম্ভাব্য দুর্যোগের মাত্রা, গতি–প্রকৃতি ইত্যাদি বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে।

আমাদের আবহাওয়া সম্পর্কিত সংকেত ব্যবস্থাটি প্রধানত নৌবন্দরকেন্দ্রিক, যা নৌযান চলাচলের সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজনের পক্ষে বোধগম্য হলেও সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্য কখনো কখনো বিভ্রান্তিকর হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস কখন কোন এলাকায় কতটা তীব্রতাসহ আঘাত হানতে পারে, তা বারবার সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় প্রচার করা প্রয়োজন। অনেক মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাব্য ঝুঁকির মাত্রা যথার্থভাবে অনুধাবন করতে পারেন না, অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে গড়িমসি এবং সময়ক্ষেপণ করে বিপদগ্রস্ত হন।

এই ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য বিপদ, সতর্ক সংকেত ও মোকাবিলার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি বা সমস্যা ছিল কি না বা থাকলে সেগুলো কী কী, তার একটি বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন হওয়া উচিত। ভবিষ্যতে এ ধরনের যেকোনো ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার ক্ষেত্রে যা আমাদের সহায়তা করবে।