পাকিস্তান বনাম মনজুর পাশতিন

সশস্ত্র বাহিনীর গণসংযোগ বিভাগের ডিজি জেনারেল গফুর হুমকি দিয়ে বললেন, মনজুর পাশতিনের পশতুন তাহফুজ মুভমেন্টকে (পিটিএম) ‘আর সহ্য করা হবে না’!
সশস্ত্র বাহিনীর গণসংযোগ বিভাগের ডিজি জেনারেল গফুর হুমকি দিয়ে বললেন, মনজুর পাশতিনের পশতুন তাহফুজ মুভমেন্টকে (পিটিএম) ‘আর সহ্য করা হবে না’!

বিষয়টি হয়তো পাকিস্তানেই সম্ভব। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একটা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্দেশে বলা হলো, ‘তোমাদের সময় ফুরিয়ে গেছে।’ সশস্ত্র বাহিনীর গণসংযোগ বিভাগের ডিজি জেনারেল গফুর গত ২৯ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে এ রকম হুমকি দিয়ে বললেন, পশতুন তাহফুজ মুভমেন্টকে (পিটিএম) ‘আর সহ্য করা হবে না’। সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে এও বলেন, ‘ওদের সময় ফুরিয়ে গেছে।’ এই ঘোষণার কারণ হিসেবে বলা হয়, পিটিএম ‘আফগানিস্তান ও ভারত থেকে তহবিল নিয়ে পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে’। 

চার্জশিট গুরুতর। কিন্তু সমস্যা হলো, পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে সেনাবাহিনী নিজেকেই কেবল স্থিতিশীলতার রক্ষাকবচ ভাবে। রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী শক্তিশালী হয় উঠলেই তাকে মনে করা হয় ‘স্থিতিশীলতার হুমকি’।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর এ রকম প্রথম হুমকি ছিলেন বাচ্চা খান। ফাতেমা জিন্নাহকেও একদা আফগানিস্তানের এজেন্ট বলতেন আইয়ুব খান। সিন্ধের জাতীয়তাবাদী জি এম সাঈদকে তো পাকিস্তানবিরোধী হিসেবে বহুদিন আটক করে রাখা হয়েছিল। সেনাবাহিনী ও দেশটির শাসক এলিটরা কালে কালে বহুজনকে ইচ্ছামতো এভাবে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সর্বশেষ তাতে যুক্ত হলো মনজুর পাশতিনের নাম।

মনজুর পিটিএমের প্রতিষ্ঠাতা। সংগঠনটি মূলত দেশটির সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষ ট্রাইবালদের ওপর নিরাপত্তাবাহিনীর নিপীড়ন নিয়ে কথা বলছে। মনজুরকে কেউ কেউ বলছেন একালের বাচ্চা খান। আবার কেউ বলছেন পশতুনদের গান্ধী। কিন্তু পাকিস্তান ‘রাষ্ট্র’ এ মুহূর্তে মাত্র ২৪ বছর বয়সী মনজুরকে প্রধান অভ্যন্তরীণ শত্রু ভাবছে। এমনকি দেশটির প্রচারমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে আগ্রহকেও খারাপ চোখে দেখা হয়। মনজুর পাশতিনের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারেই যা কিছু সংবাদ চালাচালি হয়। তাতেও রয়েছে বিশেষ গোষ্ঠীর নজরদারি। এমনকি পিটিএমের ‘সংবাদ’ নিয়ন্ত্রণের জন্য টুইটারের ওপরও রয়েছে চাপ। টুইটার পরোক্ষে স্বীকারও করেছে সে কথা।

পশতুরা পাকিস্তানের দ্বিতীয় বড় জনজাতি। জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ তারা। তবে তারা আছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে বিভক্তকারী ডুরান্ট লাইনের দুই পাশে—পাকিস্তান-আফগানিস্তান দুই দেশেই। আফগানিস্তানে তারা বারবার যুদ্ধে বিপর্যস্ত। পাকিস্তানেও আর্থসামাজিকভাবে খুবই বিপন্ন।

‘তাহফুজ’ অর্থ হলো সুরক্ষা। পশতুন তাহফুজ মুভমেন্ট বা পিটিএম প্রধানত পশতু এলাকার মানুষের বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম থেকে নিরাপত্তা চাইছে। তাদের দাবি, প্রায় কয়েক হাজার পশতুর কোনো খোঁজ মিলছে না। এলাকা থেকে মাইন সরানোও পশতুদের একটা বড় দাবি। জুলুম বন্ধ তাৎক্ষণিক প্রসঙ্গ হলেও পিটিএম ক্রমে তাদের এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদে হিস্যার কথাও তুলছে।

পিটিএম যেভাবে চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠল
পিটিএম ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী গতানুগতিক কোনো রাজনৈতিক দল নয়; বরং রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার ছাইভস্ম থেকে জন্ম নেওয়া তরুণদের এক অদলীয় মঞ্চ। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে করাচিতে পশতু তরুণ নকিবুল্লাহ মেসুদকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার পর স্বতঃস্ফূর্ত এই জন–আন্দোলনের জন্ম। আন্দোলনের ভরকেন্দ্রে আছেন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের অতি নবীন যুবক মনজুর পাশতিন। দলে দলে পশতু তরুণ-তরুণীরা বাঁধভাঙা পানির মতো এখন মনজুর পাশতিনের চারপাশে জড়ো হচ্ছে। বিশেষ করে ট্রাইবাল এলাকার দরিদ্র জনসমাজ মনজুরের মাঝে দেখছে পশতু জাতীয়তাবাদের প্রধান পুরুষ সীমান্ত গান্ধীর ছায়া।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী মূলত এই আন্দোলনের সাংস্কৃতিক শক্তি দেখে বিশেষভাবে বিস্মিত। অতি সাদাসিধে জীবনযাপনের মনজুর সচরাচর একধরনের লাল টুপি পরেন, যা আসলে পাকিস্তান-আফগান সীমান্ত অঞ্চলে ‘মাজারি টুপি’ নামে পরিচিত ছিল। পশতু তরুণ-তরুণীরা এখন সবাই এই টুপি পরে সভা-সমাবেশে আসছে। একে তারা নাম দিয়েছে ‘পাশতিন টুপি’। এভাবে পশতু জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক উপাদানও যুক্ত করে চলেছেন মনজুর পাশতিন, যা ধারণ করতে পাকিস্তানের কেন্দ্রে দরকার সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নেতৃত্ব।

কিন্তু ইতিমধ্যে বিপরীত পরিস্থিতিই কায়েম হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে পশতুদের এলাকাগুলো কার্যত নরকে পরিণত করে ফেলা হয়েছে। সন্ত্রাস ঠেকাতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্থাপিত সেনাচৌকিতে স্থানীয় লোকজন বিরক্ত। উপরন্তু, ব্যাপক হারে বাড়িঘর ধ্বংস হওয়ায় লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু। মানুষের এসব ক্ষোভের কথা বলতে গিয়েই তরুণ মনজুর অবিশ্বাস্য রকমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মনজুর ও তাঁর ২০ জন বন্ধু ডেরা ইসমাইল খান থেকে এক লংমার্চের ডাক দেন। ১ এপ্রিল যখন ওই লংমার্চ ইসলামাবাদের আসে, তখনো কেউ এটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু ছয় মাস পরই দেখা যেতে থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ভিত্তি করে ডাকা মনজুর পাশতিনের জলসাগুলোয় (জনসভা)৬০ থেকে ৭০ হাজার করে মানুষ জমায়েত হচ্ছে নিয়মিত। মনজুরকে ঘিরে পশতুন জাতীয়তাবাদের এক নবজাগরণ দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানে। এমনকি তাঁর প্রতি সহানুভূতির রেশ দেখা গেছে কাবুল পর্যন্ত। কাবুলের সরকারও মনে করছে, শক্তিশালী পশতুন আন্দোলন পাকিস্তানের সঙ্গে দর-কষাকষিতে তাদের কাজে লাগবে।

সমস্যার সমাধানে রাজনীতিবিদদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলছেন, পশতুনদের অসন্তোষের কারণগুলো যৌক্তিক। কিন্তু যেভাবে পিটিএম তুলে ধরছে, তা ‘দেশের জন্য ক্ষতিকর’। ট্রাইবাল অঞ্চলে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির জন্য তিনি সেখানকার চলমান ‘যুদ্ধাবস্থা’কে দায়ী করেন। ইমরান মূলত যা বলতে চাইছেন, তা হলো পশতুনদের ওপর নিপীড়নের জন্য সেনাবাহিনীকে যেন দোষারোপ করা না হয়। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর এই অভিমত হতাশাজনক। অন্যায়ের কথা স্বীকার করেও তিনি অন্যায়কারীকে আড়াল করতে বলছেন। কিন্তু একই ইমরান এবং একই পাকিস্তানের শাসক এলিটরা কাশ্মীরিদের নিপীড়নের জন্য ভারতের সশস্ত্র বাহিনীকে প্রায়ই নিন্দা করে যাচ্ছেন।

প্রকৃত সমস্যা হলো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান পূর্ববর্তী সরকারগুলোর মতোই দেশটির নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারেননি। গত ১৬ এপ্রিল সিনেটের একটা কমিটি পার্লামেন্ট হাউসে পিটিএমের সঙ্গে তিন ঘণ্টা বৈঠক করে তাদের দাবিদাওয়া শুনেছিল। সে সময় এই কমিটির সভাপতি সিনেট সদস্য মোহাম্মদ আলী সাইফ বলেছিলেন, এই কমিটি সরকারের নির্দেশেই কাজ করছে। অথচ এই বৈঠকের মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে পিটিএমের বিরুদ্ধে জেনারেল গফুরের হুঁশিয়ারি এল। বোঝা যাচ্ছে, সেনা আমলাতন্ত্র পশতুদের আবেগ-অনুভূতির রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে দিতে রাজি নয়, যে ভুল তারা করেছিল ১৯৭১ সালে ঢাকায়।

তুমুল জনপ্রিয়তা থাকার পরও মনজুর পাশতিন নির্বাচন করতে অস্বীকার করেন গত আগস্টে। পিটিএমকে তিনি নির্বাচনী রাজনীতি থেকে দূরে রাখার কৌশল নিয়েছেন। ক্ষমতার প্রতি এই লোভহীন ভঙ্গির কারণে দ্বিধাহীনভাবে পশতুদের ক্ষোভের কথাগুলো বলতে পারছেন তিনি, যা পাকিস্তানে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল কখনোই বলে না। এ মহূর্তে প্রতিটি জলসায় মনজুর সশস্ত্র বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেই পশতুন এলাকার সমস্যার জন্য দায়ী করছেন। এ কারণে দেশটির শক্তিশালী সামরিক আমলাতন্ত্রের জন্য পিটিএম ও মনজুরকে না থামিয়ে উপায় নেই এখন।

কিন্তু বিষয়টি সহজ নয়। কারণ, এটা গতানুগতিক কোনো সামরিক সমস্যা নয়। আবার মনজুরের জনপ্রিয়তা এমন যে পিটিএমের অন্য সংগঠকেরা সরকারের সঙ্গে হাত মেলালেও এই আন্দোলনকে থামিয়ে রাখা কঠিন।

তবে আসন্ন সপ্তাহগুলোয় মনজুর পাশতিনসহ পিটিএমের মূল সংগঠকদের নিজ নিজ এলাকার বাইরে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবে বলে মনে হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেলুচিস্তানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। পিটিএম সংগঠকদের অনেকে বিদেশে ভ্রমণেও বাধা পাচ্ছে।

সমরবাদ কি সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের বিকল্প হতে পারে?
জেনারেল গফুরের হুঁশিয়ারি থেকে স্পষ্ট, দেশটির সশস্ত্র বাহিনী পশতু জাতীয়তাবাদের উত্থানে অস্বস্তিবোধ করছে। যেমনটি তারা বোধ করত ১৯৭১–পূর্ববর্তী সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে। এ যেন এক দুরারোগ্য মনোরোগ। সেনা কর্তৃপক্ষ চাইছে, পিটিএম মানবাধিকার দলনের বিষয়ে চুপ থাকুক।

যেহেতু পশতুন জাতি আফগানিস্তানেও ছড়িয়ে আছে, তাই পিটিএমের আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি রয়েছে আফগানদের মধ্যেও। ঠিক এই কারণেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আফগানিস্তানের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনডিএসকে দায়ী করছে পিটিএমকে মদদ দেওয়ার জন্য। সেনাবাহিনী এও মনে করে, পিটিএম পশতুদের অসন্তোষ জাগিয়ে তোলার কারণে সেখানে সশস্ত্রতা ছড়াতে পারছে টিটিপি বা তেহেরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। ইতিহাসের এক বড় কৌতুক এই যে পশতু তরুণদের নিয়েই একসময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আফগানিস্তানে তালেবান বাহিনী সংগঠিত করেছিল। তাদের প্রতি পাকিস্তানের সেই সমর্থন এখনো বহাল। আবার নিজ দেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে তালেবান আদর্শের অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক যুদ্ধে লিপ্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ২০০১ থেকে অন্তত ১০টি বড় আকারের অভিযান পরিচালিত হয়েছে এখানে।

পশতুন এলাকার সামগ্রিক পরিস্থিতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য দুষ্টচক্রের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেনাবাহিনী যখনই টিটিপির বিরুদ্ধে ট্রাইবাল অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করছে, তখনই টিটিপির ক্যাডাররা আফগান অঞ্চলে লুকিয়ে পড়ছে। কিন্তু অভিযানে সাধারণ মানুষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। একের পর এক এমন অভিযান চলতে থাকায় উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ট্রাইবালদের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি চরম বৈরী আবেগের জন্ম হয়েছে, যার সুযোগ নিতে তৎপর টিটিপির মতো সংগঠনগুলোই।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য এরূপ অভিজ্ঞতা প্রথম নয়। কিন্তু মনজুর পাশতিনকে প্রতিপক্ষ ঘোষণা করে তারা প্রমাণ করছে, ৪৮ বছর আগের অভিজ্ঞতা থেকে দেশটির সেনাবাহিনী কিছু শেখেনি। সমরবাদ কখনো সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের বিকল্প হতে পারে না। পশতু তরুণদের বিরুদ্ধে চার্জশিটের ভাষা বদলাতে হবে পাকিস্তানকে।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক