বাধা সরিয়ে তরুণদের এগোতে দিন

আমরা তরুণদের এগিয়ে যেতে দিতে চাই
আমরা তরুণদের এগিয়ে যেতে দিতে চাই

উত্তরের একটি জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের ছেলে হেলাল (ছদ্মনাম)। ২০০২ সাল থেকে নিজে নিজে অনেক চেষ্টা করে কম্পিউটারে কাজ শিখেছেন। একসময় নিজে একটা প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন ঢাকায়। কিন্তু মন পড়ে থাকে নিজের গ্রামে। স্বপ্ন হয়ে ওঠে গ্রামেই কিছু করার। গ্রাম থেকে তরুণদের ঢাকায় নিয়ে এসে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। একদিন জানতে পারেন রংপুরে ব্রডব্যান্ড কানেকশন পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে রংপুর। এবার আরও বেশি গ্রামের তরুণদের নিজের কাছে এনে তৈরি করতে থাকলেন।

একদিন সকালে পাড়ি জমালেন নিজের গ্রামে। না, সেখানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রচুর টাকা খরচ করে রেডিও টাওয়ার বসিয়ে ১৫০ এমবিপিএস কানেকশন বসানো হলো, বহুতল ভবন নির্মাণ করে গড়ে তোলা হলো একটি বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান। বছর ঘুরতেই সেখানে কর্মী হয়ে গেল ১৩৫ জন, যার ২৫ জনই ওই গ্রামের মেয়ে। হেলাল এলাকায় সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি করতে শুরু করলেন, খেলার মাঠ বানালেন, এলাকার তরুণদের ব্যাডমিন্টন খেলার র‍্যাকেট কিনে দিলেন। গত বছর আমি তাঁর গ্রামে গিয়ে এসব দেখে এসেছি।

কদিন আগে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল সরকার ও বাংলাদেশ কলসেন্টার ও আউটসোর্সিং অ্যাসোসিয়েশন। সেখানে একটা অধিবেশন আমি সঞ্চালনা করেছি। বক্তাদের তালিকায় হেলালের নাম দেখে খুশি হয়েছি। সেমিনারের আগে হোটেলের লবিতে তিনি আমাকে জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মীসংখ্যা কমিয়ে ৫০-এ নামিয়ে এনেছেন! অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কেন? জানালেন, আয়কর কর্মকর্তারা এক বছরে কর্মীদের প্রায় ১ কোটি টাকা বেতন দেওয়ার তথ্য বিশ্বাস করেন না। গ্রামে কোনো ব্যাংক না থাকায় হেলাল তাদের নগদ টাকাতেই বেতন দেন, রাজস্ব টিকিট লাগিয়ে। হেলালের এই খরচ মানতে নারাজ আয়কর কর্মকর্তা। সেমিনার চলাকালীন হেলাল সাহস করে বলেছেন ওই আয়কর কর্মকর্তা তাঁর কাছে ৬ লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছেন। না দিলে খরচের টাকা আয় ধরে তাঁর আয়করের অ্যাসেসমেন্ট করে দেবেন!

দুঃখ করে তিনি বলেছেন, ওয়্যার ট্রান্সফার করে বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে যে টাকা দেশের অ্যাকাউন্টে আনেন, সেটার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে পেপলেই ইদানীং বিল নিচ্ছেন। আর সে টাকা খরচ করছেন দেশের বাইরে বেড়াতে গিয়ে। আরও জানিয়েছেন, সম্প্রতি নেপালে গিয়ে সেখানকার লোকবল ও ইন্টারনেট পরিস্থিতি দেখে এসেছেন। সেমিনার শেষে চলে যাওয়ার সময় আমাকে বললেন, ‘স্যার, দোয়া করবেন। আমার সেটআপ তুলে নেপালে নিয়ে যাব। ওখান থেকেই কাজ করব। তা হলে আর এই সব কর্মকর্তা আমাদের স্বপ্নগুলোকে গলা টিপে মারতে পারবেন না।’
আমি মাথা নিচু করে রাখলাম। বলার মতো কোনো বাক্য আমার কাছে ছিল না। আমার মনে পড়েছে একটি বহুজাতিক ফোন কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দেশে আসা তরুণ জালাল (ছদ্মনাম) হোসেইনের কথা। একাধিক টেক জায়ান্ট কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে জালাল জানতে পারেন বিশ্বজুড়ে রিফার্বিস মোবাইলের একটা বড় বাজার আছে। এটি হলো, নষ্ট মোবাইল ফোনের উপকরণগুলো আলাদা করে সেখান থেকে প্রথমে নষ্ট উপকরণগুলোকে বাদ দেওয়া। তারপর একাধিক মোবাইল ফোনের উপকরণ থেকে আবার নতুন করে মোবাইল ফোন সংযোজন করা। এটি বিশ্বজুড়ে একটি স্বীকৃত পন্থা। বিক্রির সময় এসব সেটের গায়ে ‘পুনর্নির্মিত বা রিফার্বিস’ কথাটা লেখা থাকে।

এই শিল্পের কয়েকটা লাভ। এক নম্বর হলো, পরিবেশে ই-বর্জ্যের পরিমাণ কমে যাওয়া; দুই নম্বর হলো, সেমি-স্কিল লোকের জন্য কর্মবাজারের সম্প্রসারণ এবং সবশেষে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে সাশ্রয়ী মূল্যে স্মার্টফোন তুলে দেওয়া। একটি ৪০ হাজার টাকার রিফার্বিস করা সেটের দাম নেমে আসে ১৫ হাজার টাকায়! এসব জেনেশুনে ২০১৩ সাল থেকে ঢাকায় একটি সেটআপ গড়েন জালাল। সেখানে প্রথমে ২০ জন কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। নিজের টাকায় বিদেশ থেকে নিয়ে আসেন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। ২০১৬ সালে বিদেশে তাঁর ব্যবসা ও সম্পত্তি বন্ধুর কাছে রেখে সপরিবার দেশে চলে আসেন। রিফার্বিস ফোনের একটা কারখানা গড়ে তোলেন। তিনি জানতে পারেন এ রকম কারখানা দেশে আরও আছে। কারখানা বেড়ে ৫০ জনের আর মাসে ২-৩ হাজার পিসের সক্ষমতা তৈরি হয়। কিন্তু একদিন সকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসে তঁার যন্ত্রপাতি ও লোকবল তুলে নিয়ে যায়। অভিযোগ, জালালের প্রতিষ্ঠান নতুন মোবাইল ফোন নিয়ে আসছে কিন্তু শুল্ক দিচ্ছে না! কাজেই মালামাল জব্দ ও আটক। অথচ জব্দ করা সেটগুলোর সবই পুরোনো। এগুলো স্থানীয় বাজার থেকে পুরোনো ও নষ্ট সেট হিসেবেই সংগ্রহ করা! জালালকে যেতে হয়েছে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে।

হয়তো কিছুদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের ভুল বুঝতে পারবে। কিন্তু তত দিনে, ‘আমার জমানো পাঁচ কোটি টাকা বিনিয়োগের সবই চলে গেল স্যার। দেশে ফেরার সময় অনেকেই মানা করেছিল। এখন মনে হয় তাদের কথাই সত্যি। যে দেশের কর্তৃপক্ষ রিফার্বিস আর নতুন ফোনের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে না, সেখানে ব্যবসা করে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরির চেষ্টা করাটা বোকামি। দোয়া করবেন স্যার, মামলাটা মেটাতে পারলে হয়তো আবারও দেশ ছেড়ে চলে যাব। আপনাকে দেওয়া কথা রাখতে পারব না। ক্ষমা করবেন, স্যার।’

তরুণদের নিয়ে কাজ করি বলে এমন অনেক ঘটনার কথা আমি জানি। এই দেশে কোনো কিছু করার পদে পদে কত বাধা। উদ্যোক্তাদের জীবন শুরু হয় মিথ্যা কথা বলে। হয়তো তিনি করবেন একটা তথ্যপ্রযুক্তির পরামর্শ সেবার প্রতিষ্ঠান বা তিন বন্ধু মিলে নিজেদের বাসা থেকে তৈরি করে দেবেন অন্য কোনো উদ্যোক্তার ওয়েবসাইট। কিন্তু তাঁদের ট্রেড লাইসেন্স করার জন্য একটি জাল ঘর ভাড়ার চুক্তি দেখাতে হবে। সেটিও আবার পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের লোকজন তৈরি করে দেন! আয়কর, শুল্কের কথা বলেছি। মূল্য সংযোজন করের পরিদর্শকদের হয়রানির কথা লিখলে সেটি এক মহাকাব্য হয়ে যাবে।

অথচ আমরা তরুণদের এগিয়ে যেতে দিতে চাই। তাঁরাও নির্দেশনা ও পথের সন্ধান পেতে নিজেদের উজাড় করে দিতে রাজি। গত ২৪ এপ্রিল ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে এ রকম পাঁচ সহস্রাধিক তরুণ-তরুণী ‘ক্রাউন সিমেন্ট-প্রথম আলো তারুণ্যের জয়োৎসবের’ জাতীয় পর্বে এসেছিলেন। তাঁদের প্রায় ৩০ শতাংশ এসেছেন ঢাকার বাইরে থেকে। কেউ কেউ সারা রাত ট্রেনে, বাসে বা লঞ্চে করে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। ওই দিন রাতেই আবার ফিরে গেছেন। দিনভর তাঁরা তাঁদের পথগুলোতে আমরা যেন অহেতুক বাধা না রাখি, তার মিনতি করে গেছেন। তাঁরা আশার কথা শুনতে চেয়েছেন, দিকনির্দেশনা চেয়েছেন, যার ভিত্তিতে তাঁরা নিজেরাই সাফল্যের পথে চলতে পারবেন।

দিনভর একজন তরুণকেও আমি পেলাম না, যিনি কিনা বসে বসে কিংবা কোনো কাজ না করে সফল হতে চান। সবাই জানেন কর্মযোগেই তাঁদের জয়। আমরা যাঁরা বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই, তাঁদের কাজ হবে হেলাল-জালালের মতো অসংখ্য তরুণ-তরুণীর পথের বাধাগুলো সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা। তাঁদের জন্য একটি কর্মবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। প্রয়োজনীয় নীতি-আইন তৈরি করে সেগুলো যাতে সবাই জানতে পারেন, বুঝতে পারেন তার ব্যবস্থা করা। বিদেশের বা ঢাকার চাকচিক্যকে যাঁরা পেছনে ফেলে নিজের গ্রামে শহরের সুবিধা গড়ে তুলতে চান, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের জীবন অতিষ্ঠ করা নয়। আর যেসব স্বার্থান্বেষী মহল তরুণদের নানা অছিলায় ঠেকিয়ে দিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।

মুনির হাসান: প্রথম আলোর যুব কর্মসূচি সমন্বয়ক