সাহরি খাওয়ার মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য

শরিয়তের পরিভাষায় রোজা বা সিয়াম পালন করার উদ্দেশ্যে শেষ রাতে পানাহার করাকে সাহরি বলা হয়। ইসলামি বিধানমতে, এটি সুন্নত হলেও প্রকৃতপক্ষে তাকওয়া অর্জন এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য এর গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি (সা.) বলেন, তোমরা সাহরি খাও, কেননা সাহরিতে বরকত রয়েছে। (বুখারি, সওম অধ্যায়, হাদিস: ১৮০১)। হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমাদের রোজা আর আহলে কিতাবদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া আর না খাওয়া। (মুসলিম শরিফ, আলফিয়াতুল হাদিস, পৃষ্ঠা: ১৩১)।

নিশি রাতের পর থেকে সুবেহ সাদেক তথা ফজর ওয়াক্তের পূর্বের সময়টাকে সাহরি বলা হয়। মোল্লা আলী কারী (র.) বলেন, ‘অর্ধ রাত্রি হতে সাহরির সময় শুরু হয়।’ (মিরকাত শরহে মিশকাত)। ইমাম যামাখ্শারী (র.) ও ফকিহ আবুল লাঈস সমরকন্দী (র.) বলেন, সাহরির সময় হলো রাতের শেষ তৃতীয়াংশ। সাহরি বিলম্বে খাওয়া সুন্নত। তবে সন্দেহের সময় পর্যন্ত বিলম্ব করা যাবে না, তার আগেই সাহরির নিরাপদ সময়সীমার মধ্যে পানাহার শেষ করতে হবে। হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাও; যদি তা এক ঢোঁক পানিও হয়।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাও; যদি এক লোকমা খাদ্যও হয়।’ উপরিউক্ত হাদিসসমূহ দ্বারা সাহরির গুরুত্ব বোঝা যায়। এক ঢোঁক পানি, এক লোকমা খাদ্য, এক কাপ দুধ, সামান্য ফলমূল বা একটি খেজুরের মতো যত্সামান্য হলেও সাহরির সুন্নত পূর্ণ হবে।

সারা দিন রোজা রাখার জন্য সাহরি খাওয়া অত্যন্ত সহায়ক, সাহরির সময় জাগ্রত হওয়া রোজার প্রতি আগ্রহেরও প্রমাণ। সাহরির সময় আরামের নিদ্রা বর্জন করে জাগ্রত হওয়া প্রকৃতপক্ষে ইবাদত ও আনুগত্যের প্রতি অনুরাগ। এতে শেষ রাতে জাগ্রত হওয়ার অভ্যাস হয় এবং তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের সৌভাগ্য লাভ হয়। সাহরির সময় জাগ্রত হওয়া এক প্রকারের মুজাহাদা বা সাধনাও বটে। এই সময় আল্লাহর রহমত নাজিলের সময়, অগণিত আল্লাহপ্রেমিকের ফরিয়াদ ও দোয়া কবুলের সময়, আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বাপেক্ষা উত্তম সময়। যাঁরা এই বরকতময় সময়ে জাগ্রত হয়ে আল্লাহর মহান দরবারে মোনাজাত করে থাকেন এবং ইস্তিগফার করেন, আল্লাহ তাঁদের স্বীয় ভালোবাসায় ধন্য করেন। এই ধরনের আল্লাহপ্রেমিকদের লক্ষ করে পবিত্র কোরআনে মহান রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেন, তারা (ইমানদারগণ) রাত্রির শেষ অংশে আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা) করে থাকে। (সুরা-৫১ যারিয়াত, আয়াত: ১৮)।

বরকতময় সাহরির কল্যাণকর নানান দিকসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: সুন্নতের অনুসরণ, ইসলামের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা, ইবাদতের জন্য শক্তি এবং তাকওয়া অর্জন, স্বাস্থ্য ও মনের অধিক প্রফুল্লতা লাভ, ক্ষুধার তাড়নায় সৃষ্ট প্রবৃত্তির বাসনা নিবারণ। যারা একত্রে বসে সাহরি খায়, তাদের প্রতি সৌহার্দ্যের বরকত অবতরণ হয়। সাহরির সময় দোয়া কবুলের সময়; এ সময় অধিক জিকির আজকার, তাহাজ্জুদ আদায় ও দোয়া মোনাজাতের সুযোগ লাভ হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে সাহরি বর্জন করা ঠিক নয়, সুন্নতের খেলাপ।

যদি কখনো অবস্থা এমন হয় যে ফরজ গোসল করে সাহরি খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় না থাকে; তখন অজু করে বা হাত–মুখ ধুয়ে আগে সাহরি খেয়ে নেবেন। তারপর গোসল করে ফজরের নামাজ আদায় করবেন। কারণ, সাহরি খাওয়ার জন্য পবিত্রতা ফরজ নয় বরং সুন্নত; আর নামাজ আদায় করার জন্য পবিত্রতা ফরজ। গোসল ফরজ হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গোসল করে নিতে হবে, বিনা ওজরে বেশি সময় অপবিত্র অবস্থায় থাকা সমীচীন নয়; আর রমাদানে রোজা অবস্থায় অধিকক্ষণ অপবিত্র থাকা মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়, এটি মাকরুহ। সাহরি খাওয়া সম্ভবপর না হলেও রোজা রাখতে হবে। নিজেরা সাহরি খাওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, অভাবী অসহায় মানুষের সাহরির বিষয়েও সজাগ করতে হবে।

সাওম মানে হলো পানাহার থেকে বিরত থাকা, অল্প আহার করা; তাই সাহরিতে এত বেশি খাওয়া ঠিক হবে না, যা সিয়াম বা রোজার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। মনে রাখতে হবে, রমাদান যেন ভোজের আয়োজনে পরিণত না হয়।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী : বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]