প্রাতিষ্ঠানিক অকার্যকরতাই গণতন্ত্রের বড় ঝুঁকি: ইফতেখারুজ্জামান

ইফতেখারুজ্জামান
ইফতেখারুজ্জামান
>

দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন দুর্নীতি, সুশাসন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান। 

প্রথম আলো: স্বচ্ছতা আনতে অনেক তো করলেন, যাঁদের জন্য করা, তাঁরা তো মুখ ঘুরিয়েই থাকেন।

ইফতেখারুজ্জামান: আমাদের পথচলার দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে গত এক দশকে মনে হয় আমরা বেশি সক্রিয়ভাবে কাজ করেছি। কিছু নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তো ঘটেই। যেসব খাত বা প্রতিষ্ঠান বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়, তারা আগে বসতে চাইত না, এখন সেই মনোভাবে পরিবর্তন দেখছি। যেমন এ মাসেই স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে বসার কথা রয়েছে। আরও দেখি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত অনেক সুপারিশই মানেন। নতুন মন্ত্রিসভা হওয়ার পরে বেশ কটি মন্ত্রণালয়ে আমাদের সুপারিশ গেছে। আশা করছি সব থেকে ইতিবাচক সাড়া পাব।

প্রথম আলো: বিজিএমইএর পর সম্প্রতি ওয়াসার ওপর একটি প্রতিবেদন নিয়ে একটা হইচই হলো, আগে বসেছিলেন?

ইফতেখারুজ্জামান: গবেষণা পরিকল্পনার শুরুতেই ওয়াসাকে সম্পৃক্ত করেছি। বিজিএমইএতেও আমরা এটা করেছি। কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাব থাকলেও তারা তথ্য দিয়েছে এবং প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরির পর আমরা তাদের সঙ্গে বসেছি। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং তাঁর টিমের সঙ্গেও একাধিক বৈঠক হয়। শুরুতে গবেষণার ডিজাইন বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিজিএমইএর নির্বাচন এবং তাদের ভবন ভাঙার দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসায় তাদের সঙ্গে প্রক্রিয়া অনুসরণে একটু ঘাটতি পড়ে। তবে তারা লিখিত মন্তব্য জানাবে, এমন প্রস্তাব করে খসড়া প্রতিবেদনটি চেয়ে নেয়। অবশ্য তাদের সাড়া এখনো পাইনি। প্রসঙ্গক্রমে, যে সংস্থার ওপরই আমরা রিপোর্ট করি, সেটির খসড়া নিয়ে প্রকাশের আগে আলোচনা এবং প্রকাশের দিনই আমরা তাদের কাছে তার কপি পাঠিয়ে দিই।

প্রথম আলো: ওয়াসা যখন পুরো প্রক্রিয়ায় অংশ নিল, তারা কেন প্রত্যাখ্যান করল?

ইফতেখারুজ্জামান: আমরা হতবাক হয়েছি। কারণ, যথারীতি তাদের সঙ্গেও গবেষণাটি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। মহাব্যবস্থাপক নিজে একাধিক বৈঠকে তাঁর পক্ষ থেকে তথ্য ও পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ একটি সংবাদ সম্মেলনে ওয়াসার এমডি বলেছেন, আমরা তাঁদের সম্পৃক্ত করিনি। কিন্তু তা সঠিক নয়, আমরা তো করেছি। আসলে তাঁর প্রতিক্রিয়া একটি রাজনৈতিক রূপ নিয়েছে।

প্রথম আলো: ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান ব্যক্তিগতভাবে জানতেন ওয়াসার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই আপনারা গবেষণা করেছেন?

ইফতেখারুজ্জামান: অবশ্যই জানতেন। প্রতিবেদন প্রকাশ-পূর্ব আলোচনায় তিনি ও তাঁর দুজন পরিচালককে সঙ্গে নিয়ে অংশ নেন।

প্রথম আলো: আপনি একবার পুলিশের একাংশ দুর্নীতিগ্রস্ত বলেছিলেন, সেভাবে ওয়াসা বা অন্যদেরও কি তা-ই বলা চলে? তাহলে বাদবাকিরা কী করেন? তাঁরা দুর্নীতি ঠেকান?

ইফতেখারুজ্জামান: বাকিদের মধ্যে অনেকে চেষ্টা নিশ্চয় কিছু করেন, কিন্তু তা সুফল দেয় না। যেমন ওয়াসায় পুরো ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। ব্যক্তিনির্ভর, একটি কোটারি ক্ষমতা অপব্যবহার করছে। প্রতিবেদন প্রকাশের আগে ও পরে অনেকে কাগজপত্র নিয়ে এসেছেন। কী ধরনের অনিয়ম ঘটছে, তার তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। হুইসের ব্লোয়ার অ্যাক্ট বা তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইন কার্যকর না হওয়া তাঁদের মুখ খোলাতে একটি বাধা। এই আইন কাগজেই থাকল।

প্রথম আলো: তৈরি পোশাকশ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমার বিষয়ে আপনারা সংবাদমাধ্যমে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু আসলেই কি মজুরি না বেড়ে কমেছে?

ইফতেখারুজ্জামান: ২০১৩-এর আইন অনুযায়ী, প্রতিবছর মূল মজুরি আপনা-আপনি ৫ শতাংশ বাড়বে। এটা কোনো সমঝোতার বিষয় নয়। গত পাঁচ বছরের বৃদ্ধিটা যোগ করে নতুন করে মজুরি বাড়ানোর দাবি করা হলো। তাই ২৬ শতাংশ মজুরি বাড়ানোর দাবি সঠিক নয়, বরং আইনগতভাবে প্রদেয় স্বাভাবিক মজুরি বৃদ্ধিকে নতুন মজুরি নির্ধারণ হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। ২০১৮ সালে যেটা এমনিতেই পাওয়ার কথা, তার সঙ্গে ঘোষিত বৃদ্ধির হার হিসাব করলে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে বৃদ্ধিটা বৃদ্ধি নয়, বরং সেটা কমে যাওয়া।

প্রথম আলো: দুর্নীতিতে চার ধাপ অবনতির তাৎপর্য কী। দুদক চেয়ারম্যান ব্যাখ্যা দাবি করে বলেছেন, টিআইবি একচোখা। আপনারা ব্যাখ্যা করার কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কি?

ইফতেখারুজ্জামান: আমরা এই বিষয়ে দুদকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলোচনার অপেক্ষায় আছি। তবে দুদকের সঙ্গে আমাদের একপ্রকার ‘লাভ অ্যান্ড হেট’ সম্পর্ক আছে। এক অর্থে দুদকের জন্ম আমাদের হাতে। আমরা কার্যকর দুদক চাই বলে তাদেরকে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকি। আবার যেহেতু তাদের ঘাটতি চিহ্নিত করাও আমাদের দায়িত্ব, সে কারণে তারা অনেক সময় আমাদের প্রতি বিরাগভাজন হয়। তা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে সই হওয়া একটা সমঝোতা স্মারক দ্বিতীয়বার নবায়ন হয়েছে, আশা করি তৃতীয় মেয়াদেও হবে।

প্রথম আলো: দুদক চেয়ারম্যান অধিকতর কার্যকর ও ভালো কিছু করার প্রত্যয় নিয়ে এসেছিলেন। কতটা পারলেন?

ইফতেখারুজ্জামান: আমি একমত যে শুরুতে তিনি প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছিলেন। সরকারের একাংশ ভাবে, দুদক সরকারের সৃষ্টি, তাই এটা সরকারি প্রতিষ্ঠান হবে। কিন্তু তা হওয়ার কথা নয়। সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য শীর্ষ প্রতিষ্ঠান দুদক, এই বাস্তবতা সরকারের একাংশ স্বীকার করতে চায় না। তাই তারা দুদককে চাপে রাখে। একাধিক গবেষণায় আমরা দেখেছি, দুদকের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য যথেষ্ট।

প্রথম আলো: কিন্তু সম্প্রতি একটি আইন পাসের পরে আপনি বলেছিলেন, নিন্দার ভাষা নেই।

ইফতেখারুজ্জামান: সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট যেখানে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে পূর্ব অনুমতির বিধান ফিরিয়ে আনল, সেটা সত্যিই দুদকের স্বাধীনতা খর্ব করার হাতিয়ার। আমরা হতবাক হয়েছিলাম যখন দুদক বলেছে, এটা তাদের কাজকে ব্যাহত করবে না। কিন্তু সেটা যে সত্য ছিল না, তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি। দুদক বড়জোর নিম্ন ও মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা করছে। ওপরে যাচ্ছে না। কিছু প্রতিষ্ঠানের ওপরে কাজ করে তারা প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শ দিচ্ছে। এটা তো যেকোনো এনজিওর কাজ হতে পারে। দুদকের কাজ কে বা কারা দুর্নীতিতে কীভাবে জড়িত, তার খোঁজ রাখা ও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা। দুর্নীতির পদ্ধতিতে ক্রমাগত আধুনিকায়ন হচ্ছে। অথচ এগুলো চিহ্নিত ও বিহিত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য যে দক্ষতা দরকার, সেটা দুদক পর্যাপ্তভাবে রপ্ত করতে পারেনি। সাবেক ব্যুরোর আমলের প্রচুর লোকবল থাকায় তাঁরা ব্যুরো আমলের সংস্কৃতিটা বহন করছেন। আর কমিশন সত্তা স্বাধীন হলেও এর মহাপরিচালকরাসহ অনেক পদস্থ কর্মকর্তা প্রেষণে নিযুক্ত থাকার কারণে তাঁদের আনুগত্য সরকারের কাছেই থাকছে। ফলে সরকারকে বিব্রত না করতে তাঁদের একটা অন্তর্গত শৈথিল্য থাকে, যার সামষ্টিক প্রতিফলন দেখি দুদকের সামগ্রিক কার্যক্রমে।

প্রথম আলো: দুর্নীতিবিরোধী লড়াইটা তো দুদকের একক চেষ্টা হতে পারে না। বিচার বিভাগ, মহাহিসাব নিরীক্ষক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, মানবাধিকার কমিশনসহ অন্য সংস্থাগুলো কী করছে? তারা কি ক্রমাগতভাবে নিস্তেজ হচ্ছে?

ইফতেখারুজ্জামান: এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে শুদ্ধাচার কাঠামো আছে, তার মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠান পড়ে। টিআইবিকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে ২০১২ সালে সরকার জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল অনুমোদন করেছিল। এর ওপর ভিত্তি করেই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত ও দুর্নীতি প্রতিরোধক কাজ হওয়ার কথা। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর আমরা একটি গবেষণা করেছিলাম। তার ওপর ভিত্তি করে আমি বলব, সার্বিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠান তারতম্যভেদে গভীরভাবে রাজনীতিকীকরণ হয়েছে। দলীয়করণ হয়েছে। এর মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রশাসনের মধ্যে অনেক সময় ‘দলীয় মঞ্চের’ মতো অবস্থা হতে দেখা যায়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কখনো রাজনৈতিক নেতাদের ভাষায় কথা বলেন। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির চাপে এসব সংস্থায় পেশাগত উৎকর্ষ, তাঁদের শুদ্ধাচার অবকাঠামো ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। দক্ষতা তাঁরা আর কাজে লাগাতে পারছেন না। আমি টিআইবির তরফে এবং ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি যেটা দেখছি, সেটা হলো আমাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে ফেলা। প্রায় অকার্যকরতার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এটা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো অপরিহার্য। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, এটা বাস্তবে সম্ভব বলে প্রতীয়মান হয় না। যাঁদের দ্বারা এটা করা হবে, তাঁরা কিন্তু আইনের শাসনের ঘাটতি ও বিচারহীনতা থেকে লাভবান; দলীয়করণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়—এই দুইয়ের সংমিশ্রণে এটা ঘটছে। ফলে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কখন কীভাবে পরিবর্তন আসবে, সেটা ভেবে আমি উদ্বিগ্ন। স্মরণ করাব যে এসডিজিতে সরকারের সংকল্প হলো এসব প্রতিষ্ঠান কার্যকর ও শক্তিশালী থাকবে।

প্রথম আলো: কোনটার পরিবর্তন আগে? রাজনৈতিক দল না হলে এসব প্রতিষ্ঠান কী করে ঘুরে দাঁড়াবে? রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের শুদ্ধাচার অবকাঠামো কে গড়বে?

ইফতেখারুজ্জামান: এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তবে রাজনৈতিক দল জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের আওতায় পড়বে। তার জন্য কতগুলো সুনির্দিষ্ট সূচকও চিহ্নিত করা হয়েছে। আমি বিশ্বস্ততার সঙ্গে বলতে পারি, সরকারের ভেতরের অনেকে এই বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁদেরই একজন সম্প্রতি আমাকে বলেন, ‘তুমি বলো, আমাদের কোথায় কীভাবে শুরু করতে হবে?’ আমি বলেছিলাম, ‘আপনারা যদি দলের ভেতরে পরিবর্তনের সূচনা করতে চান, তাহলে প্রথমেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে একটি প্রকৃত রাজনৈতিক দলে পরিণত করতে হবে।’ দলটি রাজনৈতিক দলের চরিত্র অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। অনেক ক্ষেত্রে দলটি এখন ক্ষমতার অপব্যবহারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা আত্মঘাতী, এখানে পরিবর্তন না এলে আমরা যে যেখান থেকে যত সংস্কারের কথাই বলি, কোনো দিন সংস্কার আনা যাবে না। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, প্রতিটি, বিশেষ করে দুই বড় দলে সংস্কার আনতে হবে।

প্রথম আলো: একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ সম্প্রতি আমাদের বলেন, একবার তিনি দুই নেত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রকাঠামোতে কতিপয় মৌলিক সংস্কার আনতে দুই বড় দলের মধ্যে একটা সমঝোতা দরকার। তার সেই চিঠি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। কারণ, বিএনপি দুর্বল হয়ে গেছে। তাই সরকারের আর পলিটিকস অব প্যাট্রোনাইজেশন দরকার নেই। সরকার চাইলেই মেধাভিত্তিক বড় সংস্কার আনতে পারে।

ইফতেখারুজ্জামান: তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে বলব, এটা তাঁর প্রত্যাশা। বিরোধী দল নেই তাই সরকারের ভয় নেই, এমন ধারণা আসলে অনেকটা ‘বেনোভলিয়ান্ট অথরেটারিয়ানিজমের প্রেসক্রিপশন’ (সদাশয় স্বৈরতন্ত্রের ব্যবস্থাপত্র)। আমাদের দেশে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় এমন বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে সদাশয় দিকটি কতটা তৈরি হয়েছে, সেটা এক জরুরি প্রশ্ন। দলের এক বা একাধিক ব্যক্তির মধ্যে তা থাকতে পারে, কিন্তু সার্বিকভাবে সংশ্লিষ্ট দলের পুরো রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক অঙ্গনের মধ্যে তা কতটা আছে, সেটা দেখতে হবে। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগপর্যন্ত আমরা একটি জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে যেতে পারব বলে মনে হয় না।

প্রথম আলো: ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে আপনি বলেছিলেন, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দলীয় সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন সম্ভব। নির্বাচনের পরে ৫০টি আসনে আপনার সমীক্ষা রিপোর্ট, যাতে ব্যাপক কারচুপির চিত্র ফুটে উঠেছে, এখন কি অবস্থান বদলাবেন? ভবিষ্যতের নির্বাচনটি দলীয় সরকারের অধীনেই চাইবেন তো?

ইফতেখারুজ্জামান: দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব, সেটি এখনো আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। তবে যদি কিছু পূর্বশর্ত পূরণ করা হয়। নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবার আগে আসে রাজনৈতিক দল। তাই সুষ্ঠু নির্বাচন পেতে চাইলে ক্ষমতাসীন দলকে সেটা আগে চাইতে হবে, গত নির্বাচনে তারা তা চেয়েছিল, সেটা বলা যাবে না। আসল কথা, ক্ষমতাসীন দল চায়নি বলে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। প্রশাসন, বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যাপক পক্ষপাতিত্ব করেছে, এমনকি সরাসরি নিরপেক্ষ নির্বাচন-পরিপন্থী ভূমিকা পালন করেছে, তা তাদের করার কথা নয়।

প্রথম আলো: ৫০ আসনের মধ্যে ৩৩টিতে আগের রাতে সিল, এটা কি ৩০০ আসনের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বশীল? কেন বিচার বিভাগীয় কমিটি চান, নিজেরা ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন না কেন?

ইফতেখারুজ্জামান: আমাদের পর্যবেক্ষণ ৩০০ আসনে অনিয়মের প্রতিনিধিত্বশীল। মামলা দায়ের করার ম্যান্ডেট আমাদের নেই।

প্রথম আলো: তাহলে এভাবেই চলবে?

ইফতেখারুজ্জামান: এটা দুর্ভাগ্যজনক, একটি অনুষ্ঠানে শুনলাম, একজন মন্ত্রী যথারীতি উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতায় সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়ার কথাই বললেন। তারপর বললেন, যদি সম্ভব হয়, তাহলে বৈষম্য কমানোর চেষ্টা করবেন। যেন অনেকটা অনুকম্পার মতো, একটা দাতব্য বিষয়। অথচ মূল বিষয় হলো আমার মৌলিক অধিকারকে অবদমিত করে যে উন্নয়ন, সেটা কিন্তু টেকসই হবে না।

প্রথম আলো: রাশেদ খান মেনন এটা চ্যালেঞ্জ করেছেন, চলমান উন্নয়নে ধনীকে অতি ধনী, গরিবের কাছ থেকে সম্পদ আরও চলে যাচ্ছে।

ইফতেখারুজ্জামান: হ্যাঁ। এটা এখনই রুখতে না পারলে ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। সরকারের এই দাবিও ঠিক যে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। পৃথিবীর খুব কম দেশেই অব্যাহতভাবে ৭ থেকে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা যায়, মেগা প্রকল্পগুলোর সুফল আমরা পাই। মানুষের আয় বাড়ছে। তবে এর সুফলটা সমাজের সব স্তরে পৌঁছাচ্ছে না। আরেকটি ঝুঁকি হলো ঋণের বোঝা। আর কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা যাদের থেকে ঋণ নিয়ে এই উন্নয়নটা করছি, সেটা সামনে আসবে। আমাদের জিডিপি এবং রাজস্বের অনুপাতটা যে বৈষয়িকভাবে সর্বনিম্নের দলে, সেটা সবাই জানে। যেসব মেগা প্রকল্প করছি, তার বোঝা দেনা পরিশোধের সময় পরিষ্কার হবে। দেশবাসীকে তখন সেই বোঝা বইতে হবে। কিছুটা ভারত এবং মোটা দাগে সবটাই চীনের ঋণে। আর চীননির্ভর উন্নয়নের নানা সিনড্রোম বিভিন্ন দেশে আমরা দেখছি।

প্রথম আলো: পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে বলেছেন, বাংলাদেশ কখনো চীনা ঋণ নেবে না।

ইফতেখারুজ্জামান: আমরা তো জানি না, চীন কী শর্তে সহায়তা দিচ্ছে। কারণ, বিশ্বের কোনো দেশই কোনো দাতব্য মনোভাব নিয়ে অন্য দেশের মেগা প্রকল্প করে দেয় না। দাতার একটা জাতীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থ থাকবে। সেগুলো আমাদের ক্ষেত্রে কী, তা অন্তত দেশবাসী জানে না।

প্রথম আলো: ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর পরপরই দেখা যাচ্ছে চীনের সঙ্গে আমরা সম্পর্ককে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যাচ্ছি। এ অবস্থায় আপনি কি সংবিধানের ১৪৫ক প্রয়োগ করতে বলবেন?

ইফতেখারুজ্জামান: অবশ্যই। এর আওতায় যদিও অতীতের সরকারগুলো বিদেশি চুক্তিগুলো প্রকাশ করেনি, তবে চীনের সঙ্গে করা চুক্তিগুলো সংসদে পেশ করা হোক। উন্নয়নের সুফল মানুষ পাবে, বোঝাটা কী, তার সেটা জানার অধিকার আছে।

প্রথম আলো: আফ্রিকায় চীন অনেক দেশকে প্রায় কিনেই ফেলেছে...

ইফতেখারুজ্জামান: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা প্রাসঙ্গিক হবে, সেটা কেউ কখনোই আশা করবে না। হয়তো অত ঝুঁকি নেই, তবে ঝুঁকি নেই তা বলব না। বিদেশি শর্তনির্ভর উন্নয়নের একটা খেসারতের দৃষ্টান্ত দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা স্থাপন করেছে। তারা চীনকে ৯৯ বছরের জন্য হাম্বানটোটা দ্বীপ ইজারা দিয়েছে। মালদ্বীপও একই অভিজ্ঞতা পেয়েছে। চীন কোনো গণতান্ত্রিক বা জবাবদিহিমূলক স্বচ্ছ দেশের উদাহরণ নয়। দেশটি বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত। আমাদের কিন্তু ভাবতে হবে।

প্রথম আলো: আপনি শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘদিন (১৯৯৯-২০০৫) একটি স্ট্র্যাটেজিক থিংক ট্যাংকের কর্ণধার ছিলেন। সেখানে মুসলিমদের একাংশ কেন আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলায় জড়াল? হোমগ্রোন?

ইফতেখারুজ্জামান: এটা অপ্রত্যাশিত। তামিলদের সঙ্গে রিকনসিলিয়েশনের প্রয়াস চলাকালে এটা ঘটল। শ্রীলঙ্কার মুসলিম সমাজ উগ্রপন্থায় যুক্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ কিংবা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের বড় কোনো দ্বন্দ্ব কখনো ছিল না। সে কারণে লঙ্কা পর্যবেক্ষকেরা হতবাক। যা ঘটল, তাতে লঙ্কার মুসলিম মানসের কোনো প্রতিফলনের প্রমাণ নেই। এটা আমাদের জন্য সাবধানবাণী। প্রতিবাদ ও বিতর্কের সুযোগহীন রাজনৈতিক পরিবেশ, বিশেষ করে বাক্‌স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবর্জিত পরিবেশে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর শক্তি বাড়ে। সহিংসতার ঝুঁকি তৈরি হয়।

প্রথম আলো: সম্পাদক ও সাংবাদিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধনের দাবি মানা হচ্ছে না। মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের সামর্থ্য কমা বা দুর্বল হওয়ার লক্ষণ দেখেন?

ইফতেখারুজ্জামান: দুর্বলতার দিকেই যাচ্ছে বেশি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নেতিবাচক ধারাগুলোর বিরুদ্ধে সম্পাদকেরা মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিলেন। তবে এখন পরিষ্কার যে সরকার এই বিষয়ে কোনো আপস করবে না। সমালোচনা যা-ই হোক, এতে তারা উদ্বিগ্ন নয়। আমলযোগ্য বিরোধী দল নিষ্ক্রিয় হওয়ার পর, তাদের দৃষ্টিতে সমালোচনার অবশিষ্ট উৎস সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ, তাদেরকেও নীরব রাখতে ওই সব বিধানের দরকার আছে। তবে তারা তাদের কাজ করবে, আমরা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার পালন করার চেষ্টা করে যাব। এটাই বাস্তবতা।

প্রথম আলো: সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনা নিয়ে টিআইবি যে কিছুই করল না, তার সমালোচনার কী জবাব দেবেন?

ইফতেখারুজ্জামান: প্রথমেই এই সমালোচনা মেনে নেব। বছর দুয়েক আগে আমরা গণমাধ্যমে সুশাসন বিষয়ে একটি কাজ হাতে নিই। কিন্তু পর্যাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে সে কাজটি স্থগিত করতে আমরা বাধ্য হই। মিডিয়া তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্র, কিন্তু এখান থেকেই তথ্য পেলাম না। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান খুবই উন্মুক্তভাবে তথ্য দিয়েছে। কিন্তু যাচাইয়ের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না।

প্রথম আলো: এখন কোন কোন কাজে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন?

ইফতেখারুজ্জামান: আদিবাসী, দলিত চা-শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছি। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছি। জনপ্রশাসনে শুদ্ধাচারের কৌশল কী অবস্থায় রয়েছে, তা খতিয়ে দেখার একটি কাজ শেষ পর্যায়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভূমিতে সুশাসনের ঘাটতি দুর্নীতির কারণে দৈনন্দিন জীবন সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেগা প্রকল্প ভাবনায় আছে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসনগত দিকটায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা কী রকম, সেটা দেখার চেষ্টা করছি।

প্রথম আলো: চার লাখ কোটি টাকা পাচার হলো কীভাবে? পানামা পেপারস ইত্যাদিতেও তদন্ত বা কোনো অগ্রগতি নেই।

ইফতেখারুজ্জামান: সরকার অস্বীকার করে কিন্তু ওয়াশিংটনে যাঁরা সমীক্ষাটা করেন, তাঁদের তথ্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এই পাচারের সিংহভাগের সঙ্গে ব্যবসায়ীরা জড়িত। মিসইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে তাঁরা এটা করেন। দৃশ্যত প্রভাবশালী রাজনীতিকদের একাংশের জড়িত থাকার সম্ভাবনা প্রকট। সে কারণে দুদক ভাবে, এখানে ‘হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে’। আবার টাকা ফেরত আনতে এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিঅ্যান্ডএজির সমন্বিতভাবে কাজ করার কথা, কিন্তু সেই পরিবেশ নেই। কিন্তু এটা যে সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে, তার একটি দৃষ্টান্ত (সিঙ্গাপুর থেকে কোকোর টাকা আনা) আছে। একটি হলে বাদবাকিতে নয় কেন।

প্রথম আলো: অনেকের মতে বিদেশি টাকায় কার্যকর মঙ্গল হয় না। টিআইবি বেশি কার্যকর কী করে? কত টাকায় চলে?

ইফতেখারুজ্জামান: বিনয়ের সঙ্গে বলব, আরও অনেকেই কার্যকর। প্রতি তিন বছর পর টিআইবির অ্যাক্রেডিটেশন নবায়নের বিষয়টি আন্তর্জাতিক বোর্ডে পুনঃ পরীক্ষিত হতে হয়। বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনের বাইরে কোনো অর্থ আমরা গ্রহণ বা খরচ করতে পারি না। আমরা পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মকৌশল করি। ঢাকাসহ ৪৫টি কার্যালয়ের মোট বাজেট (পাঁচ বছরের) ২২০ কোটি টাকা। বছরে খরচ ৪০ থেকে ৪৫ কোটি টাকা। দাতা হলো যুক্তরাজ্যের ডিএফআইডি, সুইডেনের সিডা, ডেনমার্কের ড্যানিডা, সুইস এসডিসি।

প্রথম আলো: বাক্‌স্বাধীনতা অনুশীলনকারীদের ট্যাক্স ফাইলে অনেক সময় টান পড়ে। আপনার ক্ষেত্রে?

ইফতেখারুজ্জামান: হয়তো খুব ব্যতিক্রম নই। তবে আমাদের জবাবদিহি নিশ্চিতের যেকোনো প্রয়াসকে স্বাগত জানাই।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

ইফতেখারুজ্জামান: ধন্যবাদ।