পবিত্র জীবনের জন্য দেহ-মনের পরিপূর্ণ রোজা

মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিদায়াত। আল্লাহ তাআলা সুরা ফাতিহায় মানুষকে হিদায়াতের প্রার্থনা শিখেয়েছেন: আমাদের সঠিক সরল পথ দেখান। (সুরা-১ ফাতিহা, আয়াত: ৪)। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই ৩০ পারা কুরআন নাজিল হয়েছে। এই জন্যই সুরা ফাতিহা ‘উম্মুল কোরআন’ বা ‘কোরআন জননী’। তাকওয়া হিদায়াতপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বললেন: এই কোরআন মুত্তাকিদের জন্য হিদায়াত। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২)।

রমজান মাসে রোজার প্রধান উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের প্রতিও; যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৩)।

তাকওয়া মুমিনের জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন প্রকৃত মুমিন তাকওয়া দ্বারাই পরিচালিত হন। তাকওয়া মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে এবং সত্কাজে অনুপ্রাণিত করে। কোরআন কারিমে বলা হয়েছে: তোমরা যারা ইমান এনেছ, তারা তাকওয়া অর্জন করো। (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৭০)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: যারা ইমান আনল এবং তাকওয়া লাভ করল, তারা আল্লাহর বন্ধু; তাদের কোনো ভয় নেই, তারা চিন্তিতও হবে না। (সুরা-১০ ইউনুস, আয়াতে: ৬২)। তাকওয়ার মূল কথা হলো, আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে সদা ভীত ও সতর্ক থাকা, নবীজি (সা.)–এর সুন্নত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর মহব্বত লাভের আশায় সদা সচেষ্ট, উৎকণ্ঠিত ও উদ্গ্রীব থাকা।

তাকওয়া মানে সাবধানতা, সতর্কতা, আত্মরক্ষা। ষড়্‌রিপু, তথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য হলো মানুষের মানবীয় গুণাবলির শত্রু। যেসব গুণ বা বৈশিষ্ট্য মানুষের জ্ঞানকে বাধাগ্রস্ত করে, তাদের বলা হয় রিপু বা শত্রু। এরা মূলত জ্ঞানের শত্রু। মানুষের মধ্যে এরূপ ছয়টি রিপু বা শত্রু রয়েছে। এগুলো মানব প্রবৃত্তিরই অংশ। এসবের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে সুসভ্য ও উন্নততর করে। রমজানের উদ্দেশ্য হলো ষড়্‌রিপুর ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভের নৈতিক শক্তি অর্জন।

তাজকিয়া অর্থ সূচিতা, পবিত্রতা, শ্রীবৃদ্ধি ইত্যাদি। পরিভাষায় তাজকিয়া হলো আত্মশুদ্ধি, অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা, আত্মিক উন্নতি, চারিত্রিক উৎকর্ষ। মূলত তাজকিয়া হলো মানব চরিত্রের নেতিবাচক গুণাবলি, যথা লালসা, অন্যায় বাসনা, পরনিন্দা, মিথ্যা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, আত্মপ্রচার, আত্ম-অহংকার, কার্পণ্য ইত্যাদি থেকে মুক্ত হওয়া। তাজকিয়া মানবজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। একজন মুমিনের প্রকৃত সাফল্য তাজকিয়ার ওপরই নির্ভর করে। আল্লাহ তাআলা বলেন: প্রকৃত তারাই সফল হলো, যারা আত্মশুদ্ধি অর্জন করল। (সুরা-৯১ শামছ, আয়াত: ৯)। তাজকিয়া মুমিন জীবনে লক্ষ্য অর্জনের অনন্য পাথেয়, যা মানুষকে উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছাতে সাহায্য করে।

ইহসান সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: তোমরা এভাবে আল্লাহর ইবাদত করো, যেন তোমরা তঁাকে দেখছ; যদি তোমরা তাঁকে দেখতে না–ও পাও, তবে নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের দেখছেন। (বুখারি, খণ্ড: ১, হাদিস: ৪৮)। পঞ্চ ইন্দ্রিয়—চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক, সংযত ব্যবহার নিশ্চিত করাই হলো রোজা। দেহ ও মনকে অন্যায় ও নিষিদ্ধ কাজ ও বস্তু থেকে বিরত রাখাই রোজার উদ্দেশ্য। আজীবন এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার সক্ষমতা অর্জন করা হলো রোজার সফলতা। হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত নুমান ইবনে বশীর (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: মানবদেহে এমন একটি গোশতের টুকরা আছে, যা পরিশুদ্ধ হলে তার পুরো শরীর সঠিকভাবে কাজ করে; আর তা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তার সমস্ত দেহই বিনষ্ট হয়; জেনে রাখো তা হলো কলব। (বুখারি, খণ্ড: ১, হাদিস: ৫০)।

তাকওয়া কলবের কাজ। রমজানে রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় রোজাদার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সব ধরনের বৈধ পানাহার ও যৌনসম্ভোগ থেকে বিরত থাকেন। নির্জন–নিরালায় দরজা–জানালা বন্ধ ঘরে গোপন স্থানে অতি সংগোপনেও রোজাদার পানাহার তথা রোজার বিপরীত কোনো কাজ করেন না। সব কাজে সব সময় সর্বাবস্থায় নেক আমলের জন্য কষ্টসহিষ্ণুতা ও পাপ বর্জনের জন্য মানসিক দৃঢ় মনোবল অর্জনই রোজার মূল শিক্ষা বা লক্ষ্য। যদি কেউ রোজা পালন করেন, কিন্তু গুনাহ ছাড়তে না পারেন, তবে রোজার প্রকৃত সুফল তিনি পাবেন না।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]