মাগফিরাত লাভের মাস রমাদান

ইনসান মানেই ভুলে যায় যে প্রথম মানুষই প্রথম ভুল করেছিলেন। ভুল–ত্রুটি, পাপ–তাপ, অন্যায়–অবিচার, জুলুম ও যাবতীয় অপরাধ যিনি ক্ষমা ও মার্জনা করেন, তিনি হলেন গাফুরুর রহিম। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দার প্রতি বিভিন্ন সময় তাঁর ক্ষমার কুদরতি হাত প্রসারিত করেন। বিশেষ করে পবিত্র মাহে রমাদানের মধ্য দশকে কোটি কোটি মানুষকে ক্ষমা করে দেন। এটি হচ্ছে রহমতের মাস, কোরআন নাজিলের মাস, ক্ষমার মাস, শবে কদরের রজনীর ফজিলতপূর্ণ মাস।

প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘রমাদান মাসের প্রথম দশক রহমত; দ্বিতীয় দশক মাগফিরাত; শেষ দশক নাজাত।’ (বায়হাকি)। রমাদান হলো তাকওয়া প্রশিক্ষণের মাস। আল্লাহ চান, তাঁর বান্দা তাঁর গুণাবলি অর্জন করে সে গুণে গুণান্বিত হোক। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও। আল্লাহর রং কী? তা হলো আল্লাহ তাআলার গুণাবলি। এর মধ্যে আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নামাবলি অন্যতম।

তিনি আরও বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার নিরানব্বইটি নাম রয়েছে, যারা এগুলো আত্মস্থ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। মহান আল্লাহর নামসমূহ আত্মস্থ করা বা ধারণ করা ও গ্রহণ করার অর্থ হলো সেগুলোর ভাব ও গুণ অর্জন করে জীবনে তার প্রতিফলন ঘটানো তথা সেই গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য নিজের কাজে–কর্মে, আচার–আচরণে প্রকাশ করা। মাগফিরাতের মূল শিক্ষা হলো আমি সবাইকে ক্ষমা করব, যাতে আমি তাঁর ক্ষমা পেতে পারি।

হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন করবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন।’ (তিরমিজি)। অন্যকে ক্ষমা করে দিলে নিজের মনের বোঝা দূর হয়, মানসিক চাপ কমে যায়, মন হালকা ও পবিত্র হয়। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর দয়া, করুণা ও ক্ষমা লাভ করা যায়।

রাসুলে আকরাম হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘দুর্ভাগা তারা, যারা রমাদান পেয়েও মাগফিরাত বা ক্ষমা লাভ করতে পারল না।’ (বুখারি শরিফ)। মহান আল্লাহ তাআলার একটি গুণ হচ্ছে ক্ষমা করা। পবিত্র কোরআনে ক্ষমার ব্যাপারে তিনটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যথা: ‘গাফফার’, এ শব্দের অর্থ হচ্ছে অত্যন্ত ক্ষমাশীল। পবিত্র কোরআনে শব্দটি পাঁচবার উল্লেখ হয়েছে। ‘গাফুর’ অর্থ পরম ক্ষমাশীল। এ শব্দটি পবিত্র কোরআনে ৯১ বার উল্লেখ হয়েছে। ‘গাফির’ অর্থ ক্ষমাকারী। যেমন, উল্লেখ করা হয়েছে: ‘তিনি গুনাহ ক্ষমাকারী’। (সুরা-৪০ মুমিন, আয়াত: ৩)। ‘জেনে রেখো, তিনি পরাক্রমশালী পরম ক্ষমাশীল’। (সুরা-৩৯ জুমার, আয়াত: ৫)। ‘হে নবী মুহাম্মদ (সা.)! আপনি আমার বান্দাদের বলে দিন, আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সুরা-১৫ হিজর, আয়াত: ৪৯)। হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে, ‘বান্দা যদি দৈনিক ৭০ বার অপরাধ করে এবং ৭০ বার ক্ষমা চায়, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।’ তাই নবী করিম (সা.) দৈনিক ৭০ বারের অধিক বা ১০০ বার ইস্তিগফার করতেন। অথচ তিনিসহ সব নবী–রাসুল ছিলেন মাসুম বা সম্পূর্ণ নিষ্পাপ।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শেষ রাতে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের ডেকে ডেকে বলতে থাকেন: “কে আছ ক্ষমা চাওয়ার? ক্ষমা চাও, আমি মাফ করে দেব।”’ (মুসলিম শরিফ)। হজরত সাদ্দাদ ইবনে আউস (রা.) হতে বর্ণিত, ‘রাসুলে পাক (সা.) ইরশাদ করেন: “কেউ যদি সকাল–সন্ধ্যায় বিশ্বাসের সঙ্গে সাইয়েদুল ইস্তিগফার পড়ে, তাহলে সে যদি ওই দিন রাত্রে বা দিবসে ইন্তেকাল করে, তাহলে সে জান্নাতি হবে।”’

হাদিস শরিফে আরও বলা হয়েছে, যদি কেউ গুনাহ মাফের উদ্দেশ্যে ইস্তিগফার করাকে নিজের ওপর আবশ্যক করে নেয়, তাহলে আল্লাহ পাক তাকে তিনটি পুরস্কার দেবেন: তার জীবনের কঠিন অবস্থা থেকে তাকে উদ্ধার করবেন, তাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেবেন, তাকে তার অচিন্তনীয় ও অকল্পনীয় স্থান থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন।

রমাদান ইবাদতের; রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। এ মাসের একটি নফল ইবাদতে একটি ফরজ ইবাদতের সওয়াব মেলে। একটি ফরজ ইবাদতে ৭০টি ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব হয়; প্রতিটি ইবাদতের সওয়াব ৭০ গুণ বেশি। এ মাসে গুনাহ করাও কঠিন অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। তাই সামর্থ্যমতো বেশি বেশি নেক আমল করার পাশাপাশি সব ধরনের বদ আমল বা গুনাহ বর্জন করতে হবে। তবেই আমরা মহান আল্লাহর ক্ষমা লাভ করব।

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]