মাতৃমৃত্যুর হার কত?

গর্ভধারণ, গর্ভাবস্থা ও সন্তান প্রসবকে কেন্দ্র করে নারীর মৃত্যু, যাকে ইংরেজিতে ম্যাটারনাল মর্টালিটি ও বাংলায় মাতৃমৃত্যু বলা হয়—বাংলাদেশে এর হার আসলে কত? জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ১৯৬। কিন্তু পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার মনে করেন, নিপোর্টের পরিচালিত সংস্থাটির ওই জরিপের তথ্য ‘বাস্তবসম্মত নয়’। তিনি দাবি করেছেন, বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার ১৭২। নিপোর্ট তাদের হিসাবটা দিয়েছে ২০১৬ সালে পরিচালিত সর্বশেষ জরিপের ভিত্তিতে, কিন্তু পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক যে দাবি করেছেন, তার ভিত্তি কী?

বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর পরিসংখ্যান সম্পর্কে শনিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘মাতৃমৃত্যু এখনো বেশি, মানছে না সরকার’। নিপোর্টের পরিচালিত জরিপটির ফলসংবলিত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করার পরিবর্তে ধামাচাপা দেওয়ার তৎপরতার কিছু বিবরণ প্রথম আলোর প্রতিবেদনে রয়েছে। নিপোর্টের জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদনে যখন দেখা গিয়েছিল যে ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে মাতৃমৃত্যুর হার কমার বদলে বেড়ে গেছে, তখন সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সমস্বরে নিপোর্টের ২০১৬ সালের জরিপের পদ্ধতি ও প্রতিবেদনের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তারা একযোগে বলে, ওই জরিপের তথ্য ঠিক নয়।

তারপর জরিপটি পর্যালোচনা করার উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি একটি উপকমিটি গঠন করে এবং সেই উপকমিটি নিপোর্টের জরিপটি পর্যালোচনা করে বলে, সেটি যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করেই পরিচালিত হয়েছে; ওই জরিপের তথ্য মাতৃমৃত্যু সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়, এমন অন্যান্য উৎসের তথ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। জরিপ পরিচালনার ক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যু শনাক্ত করার যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, তা যথাযথ ছিল। অর্থাৎ ২০১০ থেকে ২০১৬—এই ছয় বছরে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার কমেনি, বরং ১৯৪ থেকে বেড়ে ১৯৬ হয়েছে। এটা একটা বড় দুঃসংবাদ। কারণ, সারা পৃথিবীতে মাতৃমৃত্যুর হারে ক্রমে কমছে, বাড়ছে না। বাংলাদেশেও জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচকে উন্নতি হচ্ছে: গড় আয়ু বেড়েছে এবং বাড়ছে, শিশুমৃত্যুর হার কমছে, খর্বাকৃতি ও কৃশকায় শিশু জন্মের হার কমছে, নারী ও শিশুদের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তাহলে মাতৃমৃত্যুর হার না কমার কারণ কী?

নিপোর্টের ওই জরিপে কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর প্রধান দুটি কারণ প্রসবকালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি। ৫৪ শতাংশ প্রসূতির মৃত্যু ঘটে এই দুটি কারণে। কিন্তু এ দুটির কোনোটাই এত জটিল সমস্যা নয় যে প্রসূতির মৃত্যু অনিবার্য করে তোলে। রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি বন্ধ করার ওষুধ আছে, সেগুলো দুর্মূল্যও নয়, দুর্লভও নয়। কিন্তু দেশের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার ওষুধ অক্সিটসিনের নিয়মিত সরবরাহ থাকে না, আর খিঁচুনি বন্ধ করার ওষুধ ম্যাগনেশিয়াম সালফেট থাকে না তিন-চতুর্থাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। প্রয়োজনের মুহূর্তে এই দুটি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ পাওয়া যায় না বলে অনেক প্রসূতির মৃত্যু ঘটছে—এটা এমন এক দুঃখজনক তথ্য, যা কোনোভাবেই অবহেলা করার উপায় নেই। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে অক্সিটসিন ও ম্যাগনেশিয়াম সালফেটের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

তা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মাতৃস্বাস্থ্য বিভাগের সেবার মান আরও উন্নত করার জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষভাবে প্রয়োজন প্রসবসেবা প্রদানকারী কেন্দ্রগুলোতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসাসামগ্রী। সর্বোপরি, মাতৃস্বাস্থ্যসেবার সার্বিক মান বাড়ানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও দুর্নীতি বন্ধ করা প্রয়োজন, সে জন্য প্রয়োজন জবাবদিহির জোরালো ব্যবস্থা।