তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের সুযোগ করে দেয় রমজান

রমজান মাস রহমতের মাস আর রহমতের সময় হলো তাহাজ্জুদের সময়। বছরের বিশেষ রাতগুলোতে সূর্যাস্তের পরে আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে নেমে আসেন। এ ছাড়া প্রতি রাতে তাহাজ্জুদের সময়ে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার প্রথম আসমানে এসে বান্দাদের ফরিয়াদ শোনেন। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)–কে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এবং রাত্রির কিছু অংশ তাহাজ্জুদ কায়েম করবে, ইহা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে—মাকামে মাহমুদে।’ (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ৭৯)।

‘হে বস্ত্রাবৃত! রাতে দণ্ডায়মান হোন কিছু অংশ বাদ দিয়ে; অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা কিছু কম অথবা তদপেক্ষা বেশি এবং কোরআন আবৃত্তি করুন সুবিন্যস্তভাবে ও স্পষ্টভাবে। আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। নিশ্চয় ইবাদতের জন্য রাত্রিতে ওঠা প্রবৃত্তি দলনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল। নিশ্চয় দিবাভাগে রয়েছে আপনার দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা। আপনি আপনার পালনকর্তার নাম স্মরণ করুন এবং একাগ্রচিত্তে তাতে নিমগ্ন হোন।’ (সুরা-৭৩ মুজাম্মিল, আয়াত: ১-৮)। ‘হে চাদরাবৃত! উঠুন, সতর্ক করুন, আপন পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষণা করুন, আপন পোশাক পবিত্র করুন এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকুন। অধিক প্রতিদানের আশায় অন্যকে কিছু দেবেন না এবং আপনার পালনকর্তার উদ্দেশে সবর করুন।’ (সুরা-৭৪ মুদ্দাচ্ছির, আয়াত: ১-৭)।

নবীজি (সা.) তাহাজ্জুদ সব সময় পড়তেন। তাই এটি সুন্নত, অতিরিক্ত হিসেবে নফল। নবীজি (সা.)–এর জন্য এটি অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ফরজ নামাজসমূহের পর উত্তম নামাজ হলো রাতের তাহাজ্জুদ।’ (মুসলিম, আলফিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৯৭, হাদিস: ৪০৫)।

মধ্যরাতের পর বা রাতের দুই–তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে, তথা রাত দুইটার পর থেকে ফজরের ওয়াক্ত আরম্ভ হওয়ার আগপর্যন্ত তাহাজ্জুদের সময়। সাহ্‌রির সময় শেষ হলে, তথা ফজরের ওয়াক্ত শুরু হলে তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত শেষ হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর জমানায় তাহাজ্জুদের জন্য আলাদা আজান দেওয়া হতো। এখনো মক্কা শরিফ ও মদিনা শরিফে এই নিয়ম প্রচলিত আছে। তাহাজ্জুদ একাকী পড়াই উত্তম; জামাতে পড়া অনেক মুজতাহিদ ফকিহ মকরুহ বলেছেন। তাই অন্য সব সুন্নত ও নফলের মতো তাহাজ্জুদ নামাজের সুরা কিরাআত নিম্ন স্বরে পড়তে হয় এবং এর জন্য ইকামাতেরও প্রয়োজন হয় না।

কেউ কেউ মনে করেন, ‘তাহাজ্জুদ অন্ধকারে পড়তে হয়’ বা ‘তাহাজ্জুদ পড়লে জিন আসে’ অথবা ‘তাহাজ্জুদ শুরু করলে নিয়মিত আদায় করতে হয়’—এসব ভুল ধারণা। তবে কারও ঘুমের ব্যাঘাত যেন না হয় এবং প্রচারের মানসিকতা যেন না থাকে, এ বিষয়ে যত্নশীল ও সতর্ক থাকতে হবে। তাহাজ্জুদ নিয়মিত আদায় করতে পারলে তা অতি উত্তম।

স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যকে তাহাজ্জুদের জন্য ডেকে তোলা সুন্নত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা সেই স্বামীর প্রতি রহম করেছেন, যে নিজে রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে এবং তার স্ত্রীকে জাগায়। যদি সে উঠতে অস্বীকার করে, তবে তার মুখমণ্ডলে পানির ছিটা দেয়। আল্লাহ তাআলা সেই স্ত্রীর প্রতি রহম করেছেন, যে নিজে রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে এবং তার স্বামীকে জাগায়। যদি সে উঠতে অস্বীকার করে, তবে তার মুখমণ্ডলে পানির ছিটা দেয়।’ (আবুদাউদ ও নাসায়ী, আলফিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৯৭, হাদিস: ৪০৭)।

সুন্নত ও নফল নামাজে কিরাআতে তিলাওয়াতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি নয়। নফল নামাজে রুকু, সিজদাসহ প্রতিটি পর্ব দীর্ঘ করা সুন্নত ও মুস্তাহাব। এ জন্য রুকু ও সিজদায় তাসবিহ অনেকবার পড়া যায় এবং অন্যান্য পর্বেও বেশি পরিমাণে বিভিন্ন দোয়া, যা কোরআন ও হাদিসে আছে পাঠ করা যায়।

বছরের অন্যান্য সময় সাধারণত শেষ রাতে অনেকেরই ওঠা হয় না, তাই তখন তাহাজ্জুদ পড়া কঠিন হয়। রমজান মাসে যেহেতু ফরজ রোজা পালনের জন্য সহায়ক হিসেবে সাহ্‌রির সুন্নত আদায়ের জন্য আমরা সবাই উঠি এবং সাহ্‌রির সময়ই হলো তাহাজ্জুদের সময়; সুতরাং রমজানে তাহাজ্জুদ আদায় করা খুবই সহজ। তাহাজ্জুদ দুই দুই রাকাত করে আট রাকাত, বারো রাকাত বা আরও কম বা বেশিও পড়া যায়। রমজানের নফলের সওয়াব ফরজের সমান, ফরজের সওয়াব সত্তর গুণ।

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]