ইসলামের প্রথম সামরিক যুদ্ধ বদর

বদরের যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ
বদরের যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ

আজ ১৭ রমজান। ইসলামের ইতিহাসে এই দিনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এদিন সংঘটিত হয়েছিল বদরের যুদ্ধ। ২ হিজরির ১৭ রমজান মদিনার মুসলিম ও মক্কার অমুসলিমদের মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের আগে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে বেশ কিছু খণ্ডযুদ্ধ হয়। কিন্তু বদর ছিল দুই পক্ষের মধ্যে প্রথম বড় আকারের যুদ্ধ। ইসলামের এ প্রথম সামরিক যুদ্ধে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে। মুসলিমদের এই বিজয় অন্যদের কাছে এই বার্তা পৌঁছায় যে মুসলিমরা আরবে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং এর ফলে নেতা হিসেবে মুহাম্মদ (সা.)–এর অবস্থান দৃঢ় হয়।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করেন। আল আরিসা পাহাড়ের পাদদেশে মুসলিম বাহিনীর শিবির স্থাপন করা হয়। ফলে পানির কূপগুলো তাদের আয়ত্তে ছিল। আর নবী করিম (সা.) সেনা সমাবেশের জন্য এমন একটি জায়গাই বেছে নেন, যেখানে সূর্যোদয়ের পর যুদ্ধ হলে কোনো মুসলমান সেনার চোখে সূর্য কিরণ পড়বে না। অমুসলিমদের সেনাসংখ্যা ছিল ১০০০। ছিল ১০০টি ঘোড়া, ৬০০ লৌহবর্ম এবং অসংখ্য উট। অমুসলিমদের সেনাপতি ছিলেন ওতবা বিন রবিআ। যুদ্ধে ৭০ জন অমুসলিম নিহত হন এবং বন্দীও হন ৭০ জন।

এদিকে মুসলিম বাহিনীতে সেনাসংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। মুহাজির ছিলেন ৮২ জন। আর বাকি সবাই আনসার। আওস গোত্রের ৬১ জন এবং খাজরাজ গোত্রের ১৭০ জন। মুসলিমদের উট ও ঘোড়ার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে: ৭০টি ও ২ টি। যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর ১৪ জন শহীদ হন। এই যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে নবীজি (সা.)–এর প্রধান শত্রু আবু জাহেলের নিহত হওয়া। এ প্রসঙ্গে দুই কিশোরের অসীম সাহসিকতা নিয়ে একটি বীরত্বের গল্প প্রচলিত আছে। তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে।

চারদিকে শত্রুকে খুঁজছে সবাই। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) এক জায়গায় দাঁড়িয়ে লক্ষ করেছিলেন, শত্রুকে কীভাবে ঘায়েল করা যায়। তাঁর দুপাশে এসে দাঁড়াল দুটি বালক। আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)–কে তারা বলল, চাচা, আপনি আবু জাহেলকে চেনেন? আমাদেরকে দেখিয়ে দিন। আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) আবু জাহেলকে দূর থেকে দেখিয়ে দিলেন। ছুটতে ছুটতে গিয়ে আবু জাহেলের সামনে হাজির হলো দুজন বালক। আবু জাহেল ঘোড়ায় চড়ে ছুটছিলেন। বালক দুজনের পক্ষে ঘোড়ায় চড়ে থাকা আবু জাহেলের শরীরে সরাসরি আঘাত করা অসম্ভব ছিল। একজন আক্রমণ করল আবু জাহেলের ঘোড়ায়। আরেকজন আবু জাহেলের পায়ে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করল। মুহূর্তের মধ্যেই আবু জাহেল মাটিতে গড়িয়ে পড়লেন। মাটিতে পড়েই ছটফট করতে লাগলেন তিনি। বালক দুজন সমানতালে তাঁকে আঘাত করে চলল। তারা আবু জাহেলের শরীরের ওপর চড়ে বসল। তখনো আবু জাহেল মারা যাননি। দূর থেকে বালকদের অভাবনীয় আক্রমণে আবু জাহেলের এই মরণ দশা দেখে আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) এগিয়ে আসেন এবং আবু জাহেলের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। সাহসী কিশোর দুজনের একজনের নাম মাআজ। অপরজনের নাম মুআ ওয়াজ।

বদরের যুদ্ধ সে সময় সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। মদিনার অন্য আরব গোত্রগুলো মুসলিমদের নতুন শক্তি হিসেবে দেখতে শুরু করে। যুদ্ধ জয়ের ফলে নেতা হিসেবে মুহাম্মদ (সা.)–এর কর্তৃত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। বদরের বন্দীদের প্রতি হজরত মুহাম্মদ (সা.) অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করেন। এসব বন্দীকে পরে তিনি সহজ শর্তে মুক্তি দেন। অনেকেই তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মক্কা থেকে মদিনা যাওয়ার পুরোনো রাস্তায় গেলে বদরের প্রান্তর পড়ে। মক্কা থেকে ১২০ মাইল ও মদিনা থেকে ৮০ মাইল দূরে মধ্যবর্তী স্থানে এর অবস্থান। হজ করার সুবাদে বেশ কয়েকবার আমার বদরের প্রান্তরে যাওয়ার সুযোগ ঘটে। সেখানে সড়কের পাশে রয়েছে বড় একটা স্মৃতিস্তম্ভ, যাতে লেখা রয়েছে বদরের যুদ্ধে শহীদদের নাম।

বদরের যুদ্ধ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক নিদর্শন ও অনুপ্রেরণা লাভের অন্যতম শিক্ষা। এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় এটা প্রমাণ করে যে সত্যনিষ্ঠ কাজে বিজয়ের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ়তা, ধৈর্য ও সহনশীলতার বিকল্প নেই। এই রমজান মাসে তাই আমাদের প্রার্থনা আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যেকোনো কাজে সফলতা লাভে কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় সংকল্প, ধৈর্য ও সহনশীলতা পোষণের তৌফিক দান করুন, যেভাবে তিনি বদর প্রান্তরে মুসলিম বাহিনীকে দান করেছিলেন, আমিন।

ফেরদৌস ফয়সাল প্রথম আলোর হজ প্রতিবেদক
afef 78 @gmail. com