মোদিবিরোধীদের ভুলটা যেখানে
কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস—এটি বাংলা প্রবাদ। এর সারমর্ম হচ্ছে—যথাসময়ে যথোচিত ব্যবস্থা না নিলে, পরে পস্তাতে হয়। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির অবস্থা এখন এমনই। সাম্প্রদায়িক শক্তির সামর্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে একে ঠেকাতে যতটা উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল, ততটা হয়নি কংগ্রেসসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। এর ফলাফল—টানা দ্বিতীয়বারের মতো ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসছে বিজেপি।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, বিপুল আসনে জয়ী হতে চলেছে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। সংখ্যার দিক থেকে ২০১৪ সালের বিশাল জয়কেও ছাপিয়ে যেতে পারে বিজেপি। গত লোকসভা নির্বাচনে ২৮২টি আসনে জয়ী হয়েছিল বিজেপি, প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচনের শেষ দফা ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে আসেন নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তিনি বলেছিলেন, এবারও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবেই সরকার গঠন করবে বিজেপি। সেই কথাই সত্যি হতে চলেছে। যদিও নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন ও ইভিএম নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু বিপুল জয়ে বিতর্কের আঁচ অনেকটাই স্তিমিত করে দিতে পারবেন গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী।
অথচ এই বিজেপি ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে মোটে ২টি আসন পেয়েছিল। মজার বিষয় হলো, ওই নির্বাচনের পর এই প্রথম এতটা দোর্দণ্ড প্রতাপে ভারতের লোকসভায় একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করল কোনো দল। ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যার পর অনুষ্ঠিত ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে চার শতাধিক আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। আর এবার সেই দলই ৫০-এর আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ নিয়েও উঠে যাচ্ছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
সাংগঠনিক হিসাবে বিজেপির ‘গুরু’ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)। ভারতবর্ষ ভাগের পর এই চরম সাম্প্রদায়িক সংগঠনটিই ‘জনসঙ্ঘ’ নামে জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রাখে। জনসঙ্ঘই কালের পরিক্রমায় হয়েছে বিজেপি। ১৯৪৭ সালের পর যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে জনসঙ্ঘের অবস্থা ছিল সঙিন। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ধীরে ধীরে ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কল্কে পেতে শুরু করে। ঠিক সেই সময়টাতেই ভারতের সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একাধিপত্য ছিল ইন্দিরা গান্ধীর। আর তাঁর আধিপত্য খর্ব করতেই একসময় এক জোট হয়েছিল বাকি সবাই। এই একজোট হওয়ার বিষয়টিতেই কিছুটা গন্ডগোল ছিল। কারণ আদর্শের ভিত্তিতে কেউ এক মঞ্চে আসেনি। কংগ্রেসের ভেঙে যাওয়া অংশ, বামপন্থীরা এবং অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো তখন দল ভারী করতে জনসঙ্ঘকেও সঙ্গে নিয়েছিল। সেই থেকে ভারতের মূলধারার রাজনীতিতে ‘পাত্তা’ পাওয়া শুরু করে জনসঙ্ঘ।
১৯৭৭ সালের নির্বাচনে একদিকে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, আর অন্যদিকে ছিল সবাই। বাম, ডান, মধ্য—সব। ইন্দিরা–বিরোধিতাকে সামনে রেখে সৃষ্টি হয়েছিল এই ‘অদ্ভুত’ বোঝাপড়া। ওই সময় চিরকাল সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বামপন্থীরাও জনসঙ্ঘকে পাশে রেখেছিল। এভাবেই ক্ষমতার প্রশ্নে আদর্শের বিচ্যুতি হয়। ‘একনায়ক’ ইন্দিরা গান্ধীকে ঠেকাতে গিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে আরও বড় বিপদ সৃষ্টি করে বসল ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল শক্তিগুলো। নির্বাচনে জেতার পর প্রথমবার ক্ষমতার সাথি হলো জনসঙ্ঘ। সুতরাং ভারতে ক্ষমতার বলয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির দায়ও কম নয়। সেক্যুলার শক্তির প্রচ্ছন্ন মদদেই ভারতে ভিত গড়ে ফেলে সাম্প্রদায়িক শক্তি।
জনসঙ্ঘ পরে পরিণত হয় ভারতীয় জনতা পার্টিতে। ১৯৮৪ সালের পর বিজেপির অন্যতম অ্যাজেন্ডা আসলে ছিল অযোধ্যার বাবরি মসজিদের স্থানে রাম মন্দির নির্মাণ। এই অ্যাজেন্ডাকে সামনে রেখেই ফের উত্থান হয় বিজেপির। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি ও বামদের সমর্থনে কেন্দ্রে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর সরকার গঠিত হয়েছিল। রথযাত্রাকে ঘিরে সেই সরকারের ওপর থেকে সমর্থনও তুলে নিয়েছিল বিজেপি। এরপর ধর্ম ও বিভক্তিকে মূল সূত্র মেনেই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে শতাধিক আসনে জিতেছিল লালকৃষ্ণ আদভানির বিজেপি। সেই থেকে বিজেপি হয়ে উঠল ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।
এরপরই ঘটে বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা। ওই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও উন্মত্ত কর্মীদের ঠেকানোর চেষ্টা করেননি কোনো বিজেপি নেতা। এই ট্রাম্পকার্ড বরাবরই কাজে এসেছে বিজেপির। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগেও রাম মন্দির ইস্যু নিয়ে বাহাস কম হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের কল্পিত আবহ। সব মিলিয়ে একেবারে ‘নিখুঁত’ ময়দানে যুদ্ধ করেছে বিজেপি। এর বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে যেভাবে পাল্লা দিতে হতো, তা আর হয়নি। আর এখানেই ব্যর্থ কংগ্রেসসহ মোদিবিরোধীরা।
এটি ঠিক যে নরেন্দ্র মোদির মতো ব্যক্তিগত ক্যারিশমা অন্য নেতাদের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছেন না ভারতের ভোটাররা। সারা পৃথিবীতেই এখন লোকরঞ্জনবাদী নেতাদের রমরমা। যুক্তরাষ্ট্রে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ায় পুতিন, হাঙ্গেরিতে ভিক্টর অরবান, তুরস্কে আছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। উদাহরণ খুঁজলে আরও পাওয়া যাবে। এসব সরকারপ্রধানেরা কাউকে পাত্তা দেন না। ভুলভাল কথা বললেও ‘নো টেনশন’। সবার সামনে সোজাসুজি কথা বলার চেয়ে টুইট করতে তারা বেশি পছন্দ করেন। ওতে যে কারও তাৎক্ষণিক প্রশ্নের চ্যালেঞ্জে পড়তে হয় না! টুইটারে এমন নেতাদের ফ্যান-ফলোয়ারও অনেক। ট্রাম্পের যেমন টুইটারে ফলোয়ার ৬ কোটির ওপরে। ৫ কোটির কাছাকাছি ফলোয়ার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানেই আছেন নরেন্দ্র মোদি।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, তবে কি ভোটাররা ‘কাজ কম, কথা বেশি’ নীতিতে চলা প্রার্থীদেরই বেশি পছন্দ করছেন? মনে রাখতে হবে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে দেওয়া অধিকাংশ প্রতিশ্রুতিই রাখতে পারেননি মোদি। তাও তিনিই ফের আসছেন দিল্লির মসনদে। অর্থাৎ চাকরির সুযোগের বদলে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানবিরোধিতায় আকৃষ্ট হয়েছেন সিংহভাগ ভোটারই। ‘স্ট্রংম্যান’ মোদিকেই চান তাঁরা। তা তিনি যতই প্রতিপক্ষের হাতে ধরা পড়ার ভয় সত্ত্বেও ঝড়-বৃষ্টি-মেঘে যুদ্ধজাহাজ চালানোর অনুমতি দিন না কেন! এবারের নির্বাচনে তাই স্পষ্টভাবেই বিভক্তি ও ঘৃণার বেপরোয়া পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রণোদনা পেল মোদির বিজেপি।
কথায় আছে, ইতিহাস নাকি শুধু জয়ীদের মনে রাখে। জীবনমুখী গানের জনপ্রিয় শিল্পী নচিকেতা এক গানে বলেছিলেন, ‘...বিজয়ীরা বরাবর ভগবান এখানেতে, পরাজিতরাই পাপী এখানে, রাম যদি হেরে যেত, রামায়ণ লেখা হতো, রাবণ দেবতা হতো সেখানে...।’ পরিস্থিতি কি তেমনই?
অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক