ভারতে সাম্প্রদায়িকতা ও পুঁজিতন্ত্রের উল্লাস

বিশ্বজুড়ে রাজনীতিশাস্ত্রকে মানববিদ্যার অংশ হিসেবে পড়াশোনার রেওয়াজ। কিন্তু ক্রমে এই শাস্ত্র যেন বিজ্ঞানে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ভারতের এবারের নির্বাচন তার সাক্ষী।

নির্মোহ সমাজ বিশ্লেষকদের কাছে ভারতের নির্বাচনী ফল বিস্ময়ের কারণ ঘটায়নি। বহুদিন থেকে বিজেপি ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো জনমত দখলের কৃৎকৌশলে চূড়ান্ত দক্ষতা প্রদর্শন করে চলেছিল একের পর এক। যাঁরা বহুজনবাদী মূল্যবোধ ও ধর্মনিরপেক্ষ শুভবোধের দৃষ্টি দিয়ে মাঠের রাজনীতি দেখতে অভ্যস্ত, তাঁদের জন্য গান্ধীর ভারতে নাথুরাম গডসের সমর্থকদের একচেটিয়াত্বে বিপন্ন বোধ করার কারণ আছে। নিশ্চয়ই এটা এক নতুন ভারত। কিন্তু বহুত্ববাদী রাজনীতির নামে পরিবারতন্ত্রকে ভারতীয় ভোটাররা আর মেনে নিতে চাইছেন না। যেমনটি দেখা গেছে কয়েক মাস আগের পাকিস্তানের নির্বাচনেও। সিন্ধুর ভুট্টো ও পাঞ্জাবের শরিফ ডাইনেস্টিকে হতবিহ্বল করে ইমরানকে বেছে নিয়েছিলেন সে দেশের ভোটাররা। হয়তো আগামী দিনে দক্ষিণ এশিয়ার অপরাপর দেশেও এই মনোভাবের বিস্তার দেখব আমরা।

জয়ের কৃতিত্ব মূলত আরএসএসের
আসনের হিসাবে ভারতের নির্বাচনের ফল অতি অপ্রত্যাশিত নয়। বুথফেরত সমীক্ষার আগে-পরে নির্মোহ বিশ্লেষকের সবাই বলছিলেন, বিজেপি ক্ষমতায় আসছে। ভারতে বিশ্বমানের অনেক জরিপ সংস্থা রয়েছে। নির্বাচনের পর তারা প্রায় সবাই বিজেপির পুনর্নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছে।

তবে অবশ্যই অপ্রত্যাশিত অনেক কিছুও আছে এই নির্বাচনে। তার মধ্যে প্রধান হলো অ-হিন্দি জনপদগুলোতে বিজেপির ভোটের হিস্যা বিপুলভাবে বেড়ে যাওয়া। পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। এই রাজ্যে লোকসভার আসন ৪২টি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এখানে বিজেপি পেয়েছিল ১৭ ভাগ ভোট এবং মাত্র দুটি আসন। তৃণমূল পায় ৩৪টি আসন এবং ভোটের ৩৯ ভাগ। ৩৪ বছর বামপন্থীদের দ্বারা শাসিত এই রাজ্যে বিজেপি এবার ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে এবং আসন বাড়িয়েছে ১৬টি। মাত্র পাঁচ বছরে বিজেপির ভোট বৃদ্ধির হার ১৩৫ শতাংশ। আসন বৃদ্ধি আট গুণ।

একই অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের পাশের ওডিশায়। সেখানে বিজেপি গতবার একটি আসন পেয়েছিল। এবার আটটি। লোকসভার সঙ্গে ওডিশায় বিধানসভা নির্বাচনও হলো। বিগত বিধানসভায় বিজেপি ভোট পেয়েছিল ১৮ ভাগ। এবার পেয়েছে ৩৩ ভাগ। প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি।

যেসব রাজ্যে মাত্র ১০ বছর আগেও বিজেপি সামান্য নাম-নিশানা খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য ছিল, সেখানে তাদের ভোটের এরূপ নাটকীয় বৃদ্ধির কৃতিত্ব কার, এ নিয়ে অনুসন্ধান চলছে এ মুহূর্তে। অনেকেই মোদি ও অমিত শাহকে জাদুকর বলছেন। কিন্তু মাঠে-ময়দানে সমাজকর্মে যুক্ত ভারতীয়রা জানেন, বিজেপির এইরূপ ভোট বৃদ্ধি হঠাৎ কোনো প্রবণতা নয়। তাদের মূল সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিক কাজের ফলে মোদি-অমিত শাহ জুটির এই প্রাপ্তি। বিজেপির এই বিজয় কার্যত দলটির মূল সংগঠন আরএসএসের ধর্মবাদী ও জাতিবাদী রাজনীতির পক্ষে জনগণের রায় মাত্র। বহুদিনের পরিশ্রমের ফসল আরএসএস পরিবার সবে ঘরে তুলতে শুরু করেছে। নীরবে আমলাতন্ত্রও তাদের পাশে আছে। গত দুই মাসে ভারতের নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় সেটার স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে।

গত পাঁচ বছরে ভারতের যেসব রাজ্যে বিজেপির বিজয়রথ থমকে ছিল, সে রকম ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গের মতো অঞ্চলও এখন ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার পক্ষে। হিন্দুত্ববাদের এই প্রাতিষ্ঠানিকতায় ভারতীয় পুঁজিতন্ত্রের স্পষ্ট মদদ রয়েছে। মোদির বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং তাঁর দলের বিরুদ্ধে দলিত ও মুসলমানদের নির্যাতনের যেসব বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ বিভিন্ন সময় প্রচারমাধ্যমে এসেছে, ভোটাররা তা অগ্রাহ্য করেছেন। সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তার প্রশ্ন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে আদৌ আর কোনো প্রভাব ফেলতে সমর্থ কি না,Ñভারতের নির্বাচনী ফল সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে গুরুতর সন্দেহ তৈরি করেছে। মোদির সঙ্গে ভারতের এই চূড়ান্ত সংহতি কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্ব ভারতে নিরাপত্তা বাহিনীর চলমান অভিযানকে বাড়তি গতি দেবে। অন্তত কাশ্মীরে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে তা আসন্ন বিপর্যয়কর এক অবস্থার বার্তা দিচ্ছে। ভারতীয় সামরিক আমলাতন্ত্র ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের জন্য এটা উল্লসিত হওয়ার মতো মুহূর্ত বটে। তাৎক্ষণিকভাবেই দেশটির শেয়ারবাজারে তার প্রতিফলন ঘটেছে। আরএসএস এই সুযোগে সংবিধানকে সংশোধন করে ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ পরিচয় দিতে আগ্রহী হবে বলে অনুমান করা যায়।

দুর্নীতির অভিযোগ গুরুত্ব দেননি ভোটাররা
২৩ মে দুপুরের আগেই বিজেপির দ্বিতীয় মেয়াদ নিশ্চিত হওয়ামাত্র বোম্বে স্টক একচেঞ্জে ‘সেনসেক্স’ সূচক প্রায় ৪০ হাজার ছুঁয়ে গিয়েছিল। যা এর আগে কোনো দিন হয়নি। এটাও অপ্রত্যাশিত নয়। গত তিন দশকে বিজেপিই একমাত্র দল, যারা লোকসভার ৫৪৫ আসনের মধ্যে একাই প্রয়োজনীয় ২৭২-এর বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় থাকছে। এবারে তাদের প্রাপ্ত আসনসংখ্যা গতবারের চেয়েও বেশি। অর্থাৎ বিজেপিকে অর্থনৈতিক নীতি ও সিদ্ধান্তের জন্য এখন অন্য কোনো দলের সঙ্গে দর–কষাকষি করতে হবে না।

মোদির অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ধরন ইতিমধ্যে ভারতীয় সবার জানা। বৃহৎ পুঁজিপতিদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অর্থনীতিতে চীনের আগ্রাসন মোকাবিলা করতে চাইছেন তিনি। কেবল পণ্য উৎপাদনের অর্থনীতি দিয়ে নয়। বিশ্ব মুরব্বি হওয়ার দাবি জোরালো করতে বিজেপি সমরশক্তির প্রদর্শন করতেও মরিয়া। শেয়ারবাজারের প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট, মোদির গৃহীত অর্থনৈতিক নীতিমালার পক্ষে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এ–ও অপ্রত্যাশিত ছিল না যে সেনসেক্সে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আদানি ও রিলায়েন্সের শেয়ারদর। এসব কোম্পানি মোদি ও বিজেপি পরিবারের বন্ধুস্থানীয় হিসেবে প্রচার রয়েছে। বিগত পাঁচ বছর মোদি সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক খাতে বড় বড় দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার অধিকাংশই আদানি ও রিলায়েন্সকে মিলিয়ে। ভোটের ফলাফল বলছে, জনগণ দুর্নীতির অভিযোগ বিশ্বাস করেননি বা গুরুত্ব দেননি। মোদির পক্ষে জনতার রায়কে ভারতীয় বৃহৎ করপোরেটদের পক্ষে প্রশ্নহীন জনসমর্থন হিসেবেও গণ্য করা যায়। যদিও বিশাল দরিদ্র-ভারতের সঙ্গে এইরূপ উপসংহার বেশ বেমানান। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকের জন্য দৃশ্যটি উৎসাহব্যাঞ্জক।

এবারের ভারতীয় নির্বাচনের বড় এক কৌতূহল উদ্দীপক দিক হলো, কেবল বিজেপির আসনই বাড়েনি নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের আসনও বেড়েছে। কমেছে বামপন্থী এবং মধ্যপন্থী দলগুলোর আসন। সবচেয়ে বিপর্যস্ত অবস্থা বামদের। এ ক্ষেত্রেও বার্তাটি সুস্পষ্ট। ভারতে কৃষক-শ্রমিকদের অধিকারের পক্ষে বামদের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম সত্ত্বেও তাদের ভোট–সংকট প্রমাণ করছে, জনতার মনস্তত্ত্বকে করপোরেটরাই প্রভাবিত করছে সফলভাবে। মোদি করপোরেটদের পাশে নিয়ে ভারতকে পরাশক্তি হিসেবে জাহির করার যে আয়োজন করছেন, ভারতীয়রা তার মধ্যে গৌরবের কারণ খুঁজে পেয়েছেন। সামাজিক ন্যায়বিচারের চেয়েও জাতিগত আত্মশ্লাঘা যে সাধারণ্যে অধিক আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে, সেটাই প্রমাণিত করলেন বিহার, ওডিশা, ঝাড়খন্ডের কোটি কোটি দরিদ্র ভোটার। তবে করপোরেটদের দাপটের মুখে শিগগির ভারতীয় শ্রমিক ও কৃষক সমাজ বামপন্থীদের অনুপস্থিতিজনিত সংকট টের পাবে। অভিভাবকহীন বোধ করবে অনেক স্থানের দলিত, আদিবাসী, খ্রিষ্টান ও মুসলমানরাও। এটা বিস্ময়কর হলেও এখন বাস্তবতা, এককালের বামদুর্গ কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা মিলে কাস্তে–হাতুড়ি মার্কায় মাত্র একজন জিতেছেন এবং এসব স্থানে সংখ্যালঘুরাও তাঁদের ভোট দেননি। অথচ তাঁরা বরাবর বামদের ভোট–ব্যাংক হিসেবে বিবেচিত হতেন। ২০০৪ সালেও ভারতীয় লোকসভায় কাস্তে-হাতুড়ির ৫৯ জন সদস্য ছিলেন। এবার সেখানে থাকবেন মাত্র ছয়জন।

আন্তর্জাতিক পুঁজিতন্ত্র উল্লসিত
ভারতে বাম ও সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার দলগুলোকে জনবিচ্ছিন্ন করতে পারা আন্তর্জাতিক পুঁজিতন্ত্রের বড় এক সফলতার দিক। আরএসএস-বিজেপি পরিবারের চলতি কৃতিত্বে নিশ্চিতভাবেই তারা খুশি। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি ট্রাম্প প্রশাসন। চীনের বিরুদ্ধে এশিয়ায় ভারতের বিজেপি সরকার তাদের প্রধান এক মিত্র।

আবার বিস্ময়কর হলেও সত্যি, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র হিসেবে পরিচিত ‘গ্লোবাল টাইমস’ ভারতের ভোট গণনার ২৪ ঘণ্টা আগেই মোদিকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করে স্বস্তি প্রকাশ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে মোদি সরকার চীনবিরোধী বাণিজ্যযুদ্ধে অংশ নেবে না বলেই বেইজিংয়ের বিশ্বাস।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিকরাও বিশ্বাস করে, পার্লামেন্টে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া মোদির সরকার যেভাবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে,Ñকংগ্রেস বা তৃতীয় শক্তির জোট সরকার সেটা পারত না। বিশেষত বাম ও মধ্য বাম দলগুলো কোনো জোটে থাকলে সেই সরকারের পক্ষে করপোরেটদের জন্য সুবিধাজনক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বিজেপি বেশি আসন নিয়ে জিতে আসায় অধিকাংশ আন্তর্জাতিক বহুজাতিক সংস্থা স্বস্তি বোধ করছে। ১৩৩ কোটি মানুষের দেশ ভারতকে বলা হয় আজকের বিশ্বের সবচেয়ে বিকাশমান ‘বাজার’, যারা তিন বছর পরই জনসংখ্যায় চীনকে অতিক্রম করে যাবে। ইতিমধ্যে ৫০ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে এখানে। ইন্টারনেটভিত্তিক বাণিজ্যে লিপ্ত পশ্চিমা কোম্পানিগুলো উদীয়মান বিশাল এই বাজারে কোনো ছন্দপতন চাইছিল না। এমন শক্তিকেই তারা আরও বহুদিন ভারতের কেন্দ্রে দেখতে চায়, যারা ভারতের মানুষকে ক্রমে ই-কমার্সের হাতে সঁপে দেবে। ভারতীয় ভোটাররা সেই নিশ্চয়তা দিয়েছেন খোলাখুলিভাবে। ফলে মোদি যেসব অর্থনৈতিক ‘সংস্কার’ পরিকল্পনায় হাত দেবেন বলে ধারণা করা যায়,Ñতাতে বেকারত্বের চলতি ধারা আরও বেগবান হবে। ইতিমধ্যে ভারতে বেকারত্ব গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ খারাপ অবস্থায় রয়েছে বলে প্রচারমাধ্যম জানাচ্ছে। যদিও নির্বাচনে বেকারত্ব বিষয়কে মোদি পাকিস্তানে বোমা হামলার দম্ভ দিয়ে ধামাচাপা দিতে পেরেছেন এবং ভোটাররা তাতে অসন্তুষ্ট হননি।

আলতাফ পারভেজ : দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক