মমতার কৌশলেই বিজেপি এগিয়ে গেল

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথম ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বিপুলভাবে হাজির হলো। চূড়ান্ত ফল ঘোষণা হওয়ার অনেক আগেই ভোট গণনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে যায় যে দেশজুড়ে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির পক্ষে সমর্থনে যে বিপুল জোয়ার এসেছে, তা সুনামিতে পরিণত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও বিজেপি বিরাট জয় পেতে চলেছে।

ভোট গণনা শেষ হলে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ১৮টি, কংগ্রেস ২টি, বাকি ২২টি পেয়েছে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র দুটি আসন, সে জায়গায় তাদের এই অগ্রগতি দেখে রাজ্যের অন্য সব রাজনৈতিক দলই হতবাক। গতবার তৃণমূল কংগ্রেস একাই পেয়েছিল ৩৪টি আসন। এবার তারা ১২টি আসন হারিয়েছে। এই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এদিন খুবই সংক্ষিপ্ত ও সংযত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। জয়ী প্রার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেছেন, ভোটের পূর্ণাঙ্গ ফল হাতে আসার পর তাঁরা সবটা পর্যালোচনা করে দেখবেন।

মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে, অর্থাৎ তারা আগেরবার পাওয়া মোট ভোটের চেয়ে কিছু কম ভোট পেয়েছে। অন্যদিকে বিজেপির ভোট ২০১৪ সালের ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে লাফিয়ে পৌঁছে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশে। ভোটের হারের এই বিশাল বৃদ্ধি এসেছে প্রধানত বাম দলগুলো ও কংগ্রেসের ঝুলি থেকে। ২০১৪ সালে বামপন্থীদের সম্মিলিত ভোট ছিল ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ, কংগ্রেসের ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এবার দুই শিবিরেরই ভোট ক্ষয় হয়েছে।

প্রধানত, ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারপন্থী চিন্তাধারার বাহক হিসেবে পরিচিত কংগ্রেস ও বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে। রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসরে তাদের অবস্থান এখন প্রান্তিক। এই অবস্থায় শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে বিজেপি, যাদের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছে উগ্র হিন্দুত্ব, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সংখ্যালঘু বিদ্বেষ। রাজ্যের মোট ৪২টির মধ্যে অর্ধেকের মতো আসনে জেতার জায়গায় চলে আসায় বিজেপি এবার পশ্চিমবঙ্গে সরকার গড়ার স্বপ্নকে পাখির চোখ করছে। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। মাত্র দুই বছর পরই এই গুরুত্বপূর্ণ ভোট। ফলে আগামী দুই বছরে রাজ্য-রাজনীতি বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে লড়াইয়ে উত্তাল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বিপুল।

এবারের নির্বাচনী প্রচারের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলে গিয়েছেন, বিজেপি ভালো করলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে তাঁরা হারানো অধিকার ফিরিয়ে দেবেন। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ হুমকি দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ভালো ফল করলে তৃণমূল সরকারের পতন ঘটতে দেরি হবে না। মোদিও বলেছিলেন, ৪০ জন তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক তাঁর সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখছেন। ফলে অনেকের আশঙ্কা, ২০২১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে বিজেপি এ রাজ্যের সরকারকে ফেলে দিতে পারে। সে জন্য দল ভাঙানো, রাজনৈতিক হিংসা ও দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি করে আইনশৃঙ্খলার অবনতির দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা ইত্যাদি সম্ভাবনার কথাও উঠতে শুরু করেছে।

আসল কথা হলো, ২০১১ সালে জনতার রায়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তৃণমূল কংগ্রেস যেভাবে ভয়ভীতি, ক্ষমতা ও অর্থের লোভ দেখিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ভাগিয়ে এনেছিল, সেই একই পথে বিজেপিও হাঁটতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। সিপিএমের নেতা অঞ্জন বেরা যেমন মনে করিয়ে দেন, তখন তৃণমূলের হয়ে এই কাজে নেতৃত্ব দিতেন মুকুল রায়। এখন তিনি বিজেপিতে গিয়ে সেই কাজই শুরু করেছেন। ফলে সব রকম সম্ভাবনাই রয়ে যাচ্ছে। আর দল না ভাঙলেও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যে বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য ঝাঁপাবে, তা নিয়ে সংশয় নেই।

ফলে আশঙ্কা বাড়ছে রাজ্যের মুসলমানদের মধ্যেও। কলম পত্রিকার সম্পাদক ও রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য আহমেদ হাসান ইমরান যেমন মনে করেন, বাম জমানায় এবং তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায় এ রাজ্যে মুসলমানদের অহেতুক ভয় পেতে হয়নি, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়নি। এখন তো মুসলমান সমাজের মধ্যে যেসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো, বিজেপি কী হবে? এবার কি তাহলে আসামের মতো পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি) হবে? এ নিয়ে কলম, মিজান প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় (যা কিনা প্রধানত বাঙালি মুসলমান সমাজের মুখপত্র) খুব লেখালেখি হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, আসামে এনআরসি হওয়ার পর থেকেই অমিত শাহ থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব বিজেপি নেতা দাবি করতে শুরু করেন যে পশ্চিমবঙ্গেও অগ্রাধিকার দিয়ে এনআরসি করা হবে। ভোটের প্রচারেও এনআরসি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চেয়েছেন তাঁরা। আসামে এনআরসি করার পর এবার লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সাফল্য এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গে তাদের আরও উৎসাহিত করতেই পারে। আর এনআরসিতে নাম নথিভুক্ত করাতে গিয়ে আসামে বসবাসকারী কয়েক প্রজন্মের বাঙালি মুসলমানদের অনেককেই যে কী হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে, তা মনে করে একটা আশঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজে।

রজত রায় ভারতীয় সাংবাদিক