রমজানের শেষ দশকে শবে কদর অনুসন্ধান

রমজান মাসে পবিত্র কোরআন নাজিল করা হয়েছে মানবজাতির পথপ্রদর্শকরূপে এবং তা সত্য–মিথ্যা পার্থক্যকারী ও হিদায়েতের প্রমাণ। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৫)। কোরআনের ভাষায়, ‘লাইলাতুল কদর’ মর্যাদাপূর্ণ মহিমান্বিত রাত; ফারসিতে ‘শবে কদর’; যে রাতে পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন মহান আল্লাহ তাআলা। এ রাতে পবিত্র মক্কা মুকাররমার জাবালে নুর বা আলোক পর্বতে হেরা গুহায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে ফেরেশতাদের সরদার হজরত জিবরাইল (আ.)–এর মাধ্যমে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রতি মহাগ্রন্থ আল–কোরআন অবতীর্ণ হয়।

কোরআন অবতরণ এবং শবে কদরের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ কোরআনুল কারিমে ‘সুরা কদর’ নামে একটি সুরা নাজিল করেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি কদর (মর্যাদাপূর্ণ) রজনীতে। আপনি কি জানেন মহিমাময় কদর রজনী কী? মহিমান্বিত কদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ হজরত জিবরাইল (আ.) সমভিব্যাহারে অবতরণ করেন; তঁাদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে উষার উদয় পর্যন্ত।’ (সুরা-৯৭ কদর, আয়াত: ১-৫)।

কোরআনেরই সংস্পর্শে একটি সাধারণ রাত ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘শবে কদর’ রজনীর অসাধারণ সম্মানে ভূষিত হয়েছে। কোরআনের সঙ্গে যার যতটুকু সম্পর্ক ও সান্নিধ্য থাকবে, তিনি ততটুকু সম্মানিত ও মর্যাদার অধিকারী হবেন। প্রিয় হাবিব (সা.) বলেন, ‘কোরআনওয়ালাই আল্লাহওয়ালা এবং তাঁর খাস ব্যক্তি ও পরিবারভুক্ত’ (বুখারি)। হাদিস শরিফে আরও এসেছে, ‘যার অন্তরে কোরআনের সামান্যতম অংশও নেই, সে যেন এক বিরান বাড়ি।’ (মুসলিম)।

হজরত উবাদা ইবনে সামিত (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) শবে কদরের সংবাদ দেওয়ার জন্য বের হলেন, দেখলেন দুজন মুসলমান ঝগড়া–বিবাদে লিপ্ত। তারপর তিনি বললেন, ‘শবে কদর সম্বন্ধে খবর দেওয়ার জন্য আমি বের হয়েছিলাম, তোমাদের অমুক অমুক বিবাদে লিপ্ত হলো, আর তা আমা থেকে তুলে নেওয়া হলো। হয়তো এটাই তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। এখন তোমরা তা রমজানের শেষ দশকে বিজোড় রাতগুলোতে তালাশ করো।’ (বুখারি)।

মুহাক্কিক ইমামগণ বলেছেন, আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয়ে ৯টি হরফ বা বর্ণ রয়েছে; আর সুরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয় তিনবার রয়েছে; নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে সাতাশ হয়, তাই (ছাব্বিশ দিবাগত) সাতাশ রমজানের রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবলভাবে বিদ্যমান রয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি)।

শবে কদরে নির্ধারিত ফরজ ইবাদতগুলো সযত্নে পালনপূর্বক সামর্থ্যমতো সর্বাধিক নফল ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করা সুন্নত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের উদ্দেশ্যে আত্মমূল্যায়নসহ কদরের রাত জেগে ইবাদত করবে, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩০, হাদিস: ৩৪)।

শবে কদরে সূর্যাস্তের পরপরই আল্লাহ তাআলা আরশে আজিম থেকে প্রথম আসমানে নেমে আসেন এবং বান্দাদের উদ্দেশ করে ডেকে ডেকে বলতে থাকেন, ‘কে আছ পাপী ক্ষমা চাও, আমি ক্ষমা করে দেব; কে আছ দুঃখী, আমি দুঃখ মোচন করে দেব; কে আছ রোগী, আমি সুস্থ করে দেব; কে আছ দায়গ্রস্ত, আমি দায়মুক্ত করে দেব; কার রিজিকের প্রয়োজন, আমি রিজিক বাড়িয়ে দেব’—এভাবে চলতে থাকে সকাল পর্যন্ত। এ রাতে পরবর্তী এক বছরের জন্য মানুষের হায়াত, মউত, রিজিক-দৌলত বরাদ্দ হয় এবং ভাগ্য চূড়ান্ত হয়।

শবে কদরের আমলের মধ্যে কোরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ, তাসবিহ তাহলিল, জিকির আসকার, দোয়া–দরুদ, তাওবা ইস্তিগফার এবং সালাতুত তাসবিহ, সালাতুল হাজাত ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। এই রাতে কবর জিয়ারত করাও সুন্নত। ইবাদতের এই বিশেষ রাতে ঘোরাফেরা করে সময় নষ্ট করা এবং কারও ইবাদতে বিঘ্ন হয় এমন কোনো কাজ করা গর্হিত অন্যায়।

হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)–কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! (সা.), আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে ওই রাতে আমি আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তুমি বলবে “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি”। হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করা পছন্দ করেন; সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (ইবনে মাজা, সহিহ্-আলবানি)।

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক