ভারতে ভোটজয়ের কারিগর প্রশান্তের কোচিং সেন্টার

ছেলেমেয়ে মেধাবী হলেই জিপিএ-৫ পাওয়ার কোনো গ্যারান্টি নেই। তাকে কিছু কায়দাকানুন শিখতে হয়, নিয়ম করে যেতে হয় কোচিং সেন্টারে। অনেক ছাত্রছাত্রী স্কুল-কলেজে না গিয়ে কোচিংয়ে কোচিংয়ে ছুটে বেড়ায়। কোচিংশিল্প এমন স্তরে পৌঁছেছে যে এর উপকারিতা এখন আর কেউ অস্বীকার করার সাহস রাখে না। বিশেষ যত্নে থাকা ক্যাডেট কলেজসহ নানা আবাসিক স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা ছুটিছাটায় বাড়িতে এলে রেহাই নেই। বাবা-মা তাদের নিয়ে ছোটেন আগে থেকে ঠিক করে রাখা কোচিং সেন্টারে। কোচিং সেন্টারগুলো এখন এই ছেলেমেয়েদের জন্য বিশেষ প্যাকেজের ব্যবস্থা করেছে।

ভারতে বিহারের ছেলে প্রশান্ত কিশোর এ রকমই এক বিশেষ প্যাকেজের কোচিং সেন্টার খুলেছেন রাজনীতিবিদদের জন্য। নাম দিয়েছেন ‘ইন্ডিয়া পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি’। গুজরাট, বিহার, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ—কোথায় নেই তাঁর ছাত্র। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার, কংগ্রেসপ্রধান রাহুল গান্ধী, পাঞ্জাবের কংগ্রেস নেতা কাম মুখ্যমন্ত্রী অমেরেন্দ্র সিং আর হালের চমক অন্ধ্রের জগন (জগমোহন রেড্ডি)—সবাই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। এক কথায় প্রশান্ত কিশোর এখন ভারতের ভোটগুরু। মোদি তখন গুজরাটে বারবার তিনবার ফেরত আসার যুদ্ধে হালে পানি পাচ্ছিলেন না, সেই ২০১২ সালে মোদির গুজরাট বিধানসভা ভোটের হাল ধরেন প্রশান্ত কিশোর। সবাইকে তাক লাগিয়ে জিতিয়ে দেন হারের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা চিন্তিত মোদি আর তাঁর দল বিজেপিকে।

বিহারের রথাস জেলার করানে ১৯৭৭ সালে জন্ম নেওয়া প্রশান্তের পড়াশোনা বক্সার জেলায়। জনস্বাস্থ্য বা পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ হিসেবে চাকরি করতেন জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচিতে। সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইলেকশন স্ট্র্যাটেজিস্ট (নির্বাচন কৌশলী) হিসেবে নির্বাচনপ্রত্যাশীদের কোচিং সেন্টার খুলে মিডিয়ায় জোরশোর প্রচার শুরু করেন। মোদি তাঁকে ডেকে পাঠান। প্রশান্ত মোদিকে শেখান কীভাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে বাৎচিত করতে হয়, কীভাবে হাসিমুখে না রেগে জবাব দিতে হয় অস্বস্তিকর প্রশ্নের। একেবারে ওয়ান টু ওয়ান কোচিং। মোদি ছিলেন খুবই সিরিয়াস অনুগত ছাত্র। ফলও পান হাতে হাতে। ২০১৪ সারের লোকসভা নির্বাচনে প্রশান্ত কিশোরকে সঙ্গে রাখেন মোদি, তবে সাথিদের বলে দেন প্রশান্ত কিশোরের মগজের ফটোকপি করে রাখতে। তিনি যা যা বলেন, তা তফসিরসহ অক্ষরে অক্ষরে টুকে রাখতে। প্রশান্ত কিশোর না থাকলে যেন আমরা তার অভাব অনুভব না করি। আমিত শাহ তাঁর দলবল নিয়ে সে কাজটা করেন পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে।

এরপর প্রশান্ত কিশোরকে ডেকে নেন বিহারের নিতীশ কুমার। নিতীশের হয়ে একের পর এক সফল রাজনৈতিক কৌশল রূপায়ণ এবং বাস্তবায়ন করেছেন দীর্ঘদিন ধরে। বিজেপির সঙ্গে মিলেমিশে নির্বাচন আবার বিজেপি ছেড়ে লালুকে নিয়ে বিধানসভা নির্বাচন—সবই প্রশান্তের পরামর্শে আর কৌশলে। নিতীশ প্রশান্তকে দলের ভাইস চেয়ার করে নেন। প্রশান্তের ম্যাজিক দেখে তাঁর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসও। ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে তপসিয়ায় তৃণমূলের পার্টি অফিসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন প্রশান্ত; যদিও তা শেষ পর্যন্ত দানা বাঁধেনি। তবে প্রশান্ত বসে থাকেননি। তিনি ডাক পান পাঞ্জাব থেকে পাঞ্জাব কংগ্রেসপ্রধান অমেরেন্দ্র সিং তাঁকে বিহার থেকে নিয়ে যান নির্বাচনী উপদেষ্টা হিসেবে। সেখানই কোচিং সেন্টার নিয়ে চলে যান প্রশান্ত। অনেক অনেক বছর পর পাঞ্জাবে কংগ্রেস ফের ক্ষমতা মুখ দেখে। সফল হয় প্রশান্তের অপূর্ব নির্বাচনী রাজনৈতিক কৌশল। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ঝড় তুলেছিল কংগ্রেস। ১১৭টি আসনের মধ্যে ৭৭টিতে জিতে নেয় কংগ্রেস। এই সময় উত্তর প্রদেশের নির্বাচনী রাজনৈতিক কৌশলের দায়িত্বেও ছিলেন প্রশান্ত, কিন্তু উত্তর প্রদেশের নেতারা তাঁর কথা শুনতে রাজি ছিলেন না। প্রিয়াঙ্কাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রজেক্ট করে প্রচারণা কৌশল তৈরি করতে চেয়েছিলেন প্রশান্ত। তা শুনে রাজ্যের এক কংগ্রেস নেতা নাকি বলেছিলেন, ‘প্রশান্ত কিশোরকে দলের কৌশল নির্ধারণ এবং প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দলের সংগঠন এবং টিকিট বণ্টনের দায়িত্ব তার নয়।’ কেউ কেউ এ কথাও বলেছিলেন যে প্রশান্তের কাছ থেকে তাঁকে যদি রাজনীতি শিখতে হয়, তাহলে তিনি রাজনীতিই ছেড়ে দেবেন। এককথায় মোদি এবং নিতীশের সঙ্গে কাজের সময় প্রশান্ত যে স্বাধীনতা পেয়েছিলেন, উত্তর প্রদেশ কংগ্রেসে সেই সুবিধা পাননি। কংগ্রেস জিতে ফিরতে পারেনি। এটাই ছিল প্রশান্তের প্রথম ব্যর্থতা।

সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে অন্য এক খেলা দেখালেন প্রশান্ত। সারা দেশ যখন মোদি মোদি করছে, তখন অন্ধ্র প্রদেশে অন্য ভাও। প্রশান্তের বুথভিত্তিক সংগঠন তৈরি আর জুতসই স্লোগান দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়ার কৌশল হাতে হাতে ফল দিয়েছে। অন্ধ্রের ওয়াইএসআর কংগ্রেসের প্রধান জগন মোহন রেড্ডি রাজ্যের ১৭৫টি বিধানসভা আসনের ১৫২টি আসনেই জয় পেয়েছেন ২৫টি লোকসভা আসনের বেশির ভাগই নিজেদের দখলে রেখেছেন। ওয়াইএসআর জগন রেড্ডির সাফল্য নজর কেড়েছে গোটা দেশের। জগন-ঢেউয়ে ভেসে গেছেন জাতীয় রাজনীতিতে উদিত হতে চাওয়া চন্দ্রবাবু নাইডু। তিনি শেষ মুহূর্তে কিছু প্রকল্প ঘোষণাও করেও ব্যর্থ হয়েছেন। অন্ধ্র প্রদেশে এবার ১৫ মাসের পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছিলেন প্রশান্ত-জগন। তাঁদের মূল কৌশল ছিল সরাসরি মানুষ বা ভোটারদের সঙ্গে কথা বলা। প্রচারের স্লোগান ছিল ‘রাভালি জগন, কাভালি জগন’ (আমরা জগনকে চাই, জগনকে জিততেই হবে)। চন্দ্রবাবুকে আর বিশ্বাস নয়, এই দাবিও ছিল প্রচারের সুরে তালে। তাঁর নির্বাচনী থিম সং সংক্রামিত হয় দাবানলের মতো। পেজ ভিউয়ার ছিল ২ দশমিক ২৫ কোটি।

প্রধানমন্ত্রী হতে গিয়ে নিজের মুখ্যমন্ত্রিত্বের কুরসি হারিয়েছেন চন্দ্রবাবু নাইডু। গোটা অন্ধ্রে ধবল স্নানের শিকার হয়েছেন ডিজিটাল স্মার্ট তেলুগু দেশম পার্টি। নতুন শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টি। লোকসভাতেও এখন তারা তৃতীয় বৃহত্তম। বেঁচে থাকুক কোচিং ব্যবসা।