রমজানে দরুদ পাঠের ফজিলত

রমজান মাসে রোজাদাররা সিয়াম সাধনা করে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রয়াস চালান। ইবাদত গ্রহণযোগ্য বা দোয়া কবুল হতে মহানবী (সা.)-এর ওপর দরুদ পাঠ করা অত্যন্ত জরুরি। দরুদ শরিফ পাঠে আল্লাহর দরবারে ইবাদতের বিনিময় সুনিশ্চিত হয়। আল্লাহর কাছে সমুদয় ইবাদত-বন্দেগি গ্রহণযোগ্য করতে পরম ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাপূর্ণ অন্তরে নিবিষ্টভাবে নবী করিম (সা.)–এর ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা নেক আমল। তাই মাহে রমজানে প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের উচিত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর অধিক দরুদ পাঠ করা। কেননা দরুদ পড়া এমন এক ইবাদত, যা আল্লাহ অবশ্যই কবুল করেন। এমনকি স্বয়ং আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবের ওপর সব সময় দরুদ পড়েন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর দরুদ ও সালাম পেশ করে (অনুগ্রহ প্রার্থনা করে)। হে মুমিনগণ! তোমরাও নবীর ওপর দরুদ পড়ো (অনুগ্রহ প্রার্থনা করো) এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।’ (সূরা আল-আহজাব, আয়াত: ৫৬)
মাহে রমজানে বেশি বেশি দরুদ পড়া ও সালাম পেশ করা অতীব বরকত ও পুণ্যময় আমল। দরুদ পাঠ আল্লাহর কাছে এতই পছন্দনীয় যে নিজেও পড়েন এবং তাঁর বান্দাদের দরুদ পড়ার হুকুম জারি করেছেন। তাই দরুদ শরিফ পাঠের ফজিলত অপরিসীম। একদিন এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে নামাজ পড়ে এই দোয়া করল: ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার গুনাহ মাফ করো এবং আমার ওপর রহম করো!’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন: ওহে মুসল্লি! তুমি খুব জলদি করেছ। শোনো, যখন তুমি নামাজ পড়বে তখন প্রথমে আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করবে, তারপর আমার ওপর দরুদ পাঠ করবে এবং (পরিশেষে নিজের জন্য) দোয়া করবে।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাঈ, মিশকাত)
হজরত কাব ইবনে ওজারা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনার ওপর আমরা কীভাবে দরুদ পড়ব?’ তিনি বললেন, বলো: ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আ-লি মুহাম্মাদ কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আ-লি ইবরাহিম ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ; আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আ-লি মুহাম্মাদ কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আ-লি ইবরাহিম ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর বংশধরদের ওপর এই রূপ রহমত নাজিল করো, যেমনটি করেছিলে ইবরাহিম ও তাঁর বংশধরদের ওপর। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসনীয় ও সম্মানীয়। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর বংশধরদের ওপর বরকত নাজিল করো, যেমন বরকত নাজিল করেছিলে ইবরাহিম ও তাঁর বংশধরদের ওপর। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসনীয় ও সম্মানীয়। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)
ভক্তিসহকারে দরুদ শরিফ পাঠের মাধ্যমে বান্দার গুনাহখাতা মাফ করা হয়। দরুদ পাঠের অশেষ সওয়াব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর মাত্র একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার ওপর ১০ বার রহমত নাজিল করেন এবং কমপক্ষে তার ১০টি গুনাহ মাফ করেন। তার আমলনামায় ১০টি সওয়াব লিপিবদ্ধ করেন এবং আল্লাহর দরবারে তার মর্যাদা ১০ গুণ বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়।’ (নাসাঈ) তিনি আরও বলেন, ‘সেই ব্যক্তির নাক মাটিতে ঘেঁষে যাক, যার কাছে আমার নাম উচ্চারিত হয় অথচ সে আমার ওপর
দরুদ পড়ে না।’ (তিরমিজি) তিনি বলেন, ‘কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে, যে ব্যক্তি আমার ওপর সবচেয়ে বেশি দরুদ পড়ে।’ (তিরমিজি)
দৈনন্দিন জীবনে দরুদ শরিফ পাঠের দ্বারা আল্লাহর দরবারে মানুষের দোয়া কবুল হয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে ‘কোনো দোয়াই আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না, যতক্ষণ সে দোয়ার আগে ও পরে নবী করিম (সা.)-এর ওপর দরুদ পড়া না হয়।’ হাদিসে আরও বর্ণিত আছে, ‘যে ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-এর পবিত্র নাম শোনার পর তাঁর ওপর দরুদ পড়ে না, সে ব্যক্তি সবচেয়ে বড় কৃপণ। তার ধ্বংসের জন্য জিব্রাইল (আ.) দোয়া করেন।’ হজরত ওমর ফারুক (রা.) বলেন, ‘দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত আসমান ও জমিনের মধ্যখানে লটকে থাকে, ওপরে ওঠে না, যতক্ষণ পর্যন্ত নবী করিম (সা.)-এর ওপর দরুদ না পড়ে।’ (তিরমিজি, মিশকাত)
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে নবী করিম (সা.)-এর জীবনচরিতের সুমহান গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে দরুদ শরিফে। ইশকে রাসুল (সা.) বা নবীপ্রেমের আবেগ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সেরা নজরানা দরুদ শরিফ। তাই ইহকাল ও পরকালের উন্নতি, মুক্তি ও সব বিপদ-আপদ, দুর্যোগ-দুর্দশা থেকে বাঁচার জন্য দরুদ শরিফ নিয়মিত পাঠ করার অভ্যাস করুন! এতে অশেষ উন্নতি ও কল্যাণ নিহিত। বহুভাবে দরুদ শরিফ পড়া যায়। তবে উল্লেখযোগ্য ও ফজিলতপূর্ণ দরুদ হচ্ছে, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়্যেদিনা মুহাম্মাদিন ওয়ালা আলি সাইয়্যেদিনা মুহাম্মাদিন ওয়া বারিক ওয়াসাল্লিম।’
প্রতিদিন নিয়মিতভাবে বিশুদ্ধ অন্তরে বিভিন্ন দরুদ পাঠে মানুষ আল্লাহর করুণা, দয়া এবং মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসা লাভ করতে পারেন। নবী করিম (সা.) হচ্ছেন মানবতার করুণাধারা ও আল্লাহর রহমতের কেন্দ্রবিন্দু। জগতে এত পাপাচার, অনাচার, হানাহানি ও জুলুম-নিপীড়নে মানুষের সম্পৃক্ততা সত্ত্বেও শুধু তাঁর কারণেই এখনো আল্লাহর রহমতের ঝরনাধারা অবারিত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ধরাধামে শুভাগমন ও উপস্থিতির সুবাদে আল্লাহর ক্ষমা ও দয়ায় জগৎজুড়ে সমগ্র মানবতা ধন্য হচ্ছে। এ জন্য উম্মতকে সব সময় নবী করিম (সা.)-এর মেহেরবানির কথা স্মরণ, কৃতজ্ঞতার প্রতিদান হিসেবে বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠে সচেষ্ট হতে হবে। আল্লাহ তাআলা মাহে রমজানে বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠে রোজাদারদের শান্তিময় সৌভাগ্যের দ্বার উন্মুক্ত করার সুযোগ দিন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক।
[email protected]