সমস্যা স্বীকার না করলে সমাধান পাওয়া যাবে না

তৌহিদ হোসেন
তৌহিদ হোসেন

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে, এটা বিচিত্র কিছু নয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যেমন চ্যালেঞ্জ থাকবে তেমনি বহির্দেশীয় ক্ষেত্রেও।

আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ সব সময়ই ছিল, হয়তো তার প্রকৃতি ছিল ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়। স্বাধীনতার পর চ্যালেঞ্জ ছিল কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও দেশ পুনর্গঠনে বহির্বিশ্বের সহায়তা। সেসব চ্যালেঞ্জ আমরা আমাদের সীমিত সামর্থ্যে ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছি। 

এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ যেমন বড়, সামর্থ্যও তেমনি বেশি।

ভারত আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ও বন্ধু, তাই আমার মতে পররাষ্ট্রনীতির প্রথম ও স্থায়ী চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যে বন্ধুদেশের মধ্যেও চাওয়া–পাওয়ার হিসাবটা থেকে যায়। ভারতের প্রধান উদ্বেগ ছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদপ্রসূত নিরাপত্তাঝুঁকি। বাংলাদেশ সেই ঝুঁকি পুরোপুরি দূর করেছে। ট্রানজিট বিষয়েও অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু তিস্তার মতো একটি ছোট্ট সমস্যার সমাধান আজও হয়নি, যদিও পরপর ভারতের দুটি সরকারের প্রধানই এ বিষয়ে ওয়াদা করেছিলেন। জেআরসি বৈঠক হচ্ছে না। সীমান্তে হত্যা এখনো বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশের পণ্য ভারতে যাওয়ার বিষয়ে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা রয়ে গেছে। এ রকম আরও ছোটখাটো ইরিট্যান্টগুলো (অস্বস্তিকর বিষয়) ভারত চাইলেই দূর করতে পারে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। কালক্রমে হয়তো এর অনেকগুলোই দূর হয়ে যাবে।

তবে এ মুহূর্তে নিঃসন্দেহে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা সংকট। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে আমি এবং আরও অনেকে শুরু থেকেই দ্বিমত পোষণ করে আসছি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে স্পষ্টভাবেই বলেছেন, ‘পূর্ণ মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের ভিত্তিতে তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে হবে।’ কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে এর প্রতিফলন তেমন দেখা যায় না। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার নামে আমরা মিয়ানমারের অনেক শর্ত মেনে নিয়েছি। এমনকি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রোহিঙ্গা না বলার আবদারও। তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকার না করলে মিয়ানমারের যুক্তিই মেনে নেওয়া হয় যে তারা সে দেশের নাগরিক নয়। মিয়ানমারে জাতিসত্তার স্বীকৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের সংবিধানে ১৪৭টি জাতিসত্তার স্বীকৃতি আছে। কিন্তু তারা রোহিঙ্গাদের স্বীকার করছে না।

দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান করতে হলে মিয়ানমারে যারা জাতিগত নিধন অভিযান চালিয়েছে, তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অতীতে যেসব দেশে জাতিগত নিধন হয়েছে, সেসব দেশে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার পরই সমস্যার সমাধান হয়েছে। এটি রুয়ান্ডায় ঘটেছে, যুগোস্লাভিয়ায় ঘটেছে। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রেও বিচারের দাবিটি সামনে আনতে হবে। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, যে সেনাবাহিনী নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে, তাদের দিয়েই মিয়ানমার সরকার তদন্ত করাচ্ছে। এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে।

জাতিসংঘের মহাসচিব যখন জাতিগত নিধন বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন গণহত্যা নিয়ে কথা বলছে, তখন আমরা ছিলাম অনেকটাই নীরব। ইদানীং এ ব্যাপারে খানিকটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। আমি মনে করি, আরও শক্ত ভাষায় কথা বলতে হবে। প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরতে হবে, মিয়ানমার তাতে অসন্তুষ্ট হলেও।

আমার ধারণা, রোহিঙ্গা সমস্যার শিগগিরই কোনো সমাধান হচ্ছে না; দীর্ঘদিন আমাদের এই বোঝা বইতে হবে। মিয়ানমার হয়তো লোকদেখানোর জন্য কিছু মানুষকে ফেরত নেবে। বাকিরা এখানেই থেকে যাবে। এটাই উদ্বেগের বিষয়। রোহিঙ্গা শিবিরে জন্মহারের কথা চিন্তা করুন। সমস্যাটি কয়েক বছর প্রলম্বিত হলে আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শিশু সেখানে জন্ম নেবে। তারা শুধু আমাদের অর্থনীতির ওপরই চাপ সৃষ্টি করবে না, সামাজিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আশ্রয়শিবির থেকে বেরিয়ে জনসমুদ্রে মিশে যাওয়ার প্রয়াস ঠেকানোও আরেকটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সরকার যে ভারসাম্যের কূটনীতি নিয়েছে, সেটি সঠিক বলে আমি মনে করি। আমরা দুই দেশকেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে ভাবি। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা আমাদের বিরুদ্ধ পক্ষে দাঁড়িয়েছে, এটাই যা দুঃখের বিষয়। এ সত্যকে মেনে নিয়েই আমাদের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। রোহিঙ্গা চুক্তির বিষয়ে চীনাদের একটি ভূমিকা ছিল বলে ধারণা আছে। যদি সেটি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আমরাও তো চীনা বন্ধুদের বলতে পারি, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে তোমরা মিয়ানমারকে রাজি করাও।

রোহিঙ্গা সমস্যার বাইরে বাংলাদেশের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিদেশে শ্রমবাজার ধরে রাখা। আমাদের শ্রমবাজারটি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশ থেকে এখন শ্রমিক নিচ্ছে না। অথচ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল থেকে নিচ্ছে। মালয়েশিয়ার বাজারও খুলবে খুলবে করে খুলছে না। দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি এই বিপর্যয়ের কারণ। এ সমস্যার সমাধান না হওয়ার কারণ, যাঁরা এখান থেকে শ্রমিক পাঠান, তাঁরা রাজনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী। সরকার তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে মধ্যপ্রাচ্যে একধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা চলছে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। চলছে ইয়েমেনে যুদ্ধ। ইরাকে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। লিবিয়ায়ও যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে প্রবাসী জনশক্তির ওপর বড় ধাক্কা আসতে পারে। সৌদি আরবে যে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক আছেন, তাঁদের সুরক্ষার জন্য দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশ সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই করেছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাতে যুক্তি আছে। তবে সমঝোতা স্মারক সই হলেও কোনোভাবেই ইয়েমেনের যুদ্ধে আমাদের জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না। ইরাক যুদ্ধেও আমরা জাতিসংঘ অনুমোদিত কোয়ালিশনকে সমর্থন জানিয়েছিলাম। কিন্তু যুদ্ধে জড়াইনি। ইয়েমেন যুদ্ধে কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সে রকম অনুমোদন নেই। এ ছাড়া সৌদি আরব সামান্য অখুশি হলেই ১০ লাখ লোককে ফেরত পাঠিয়ে দেবে, আমার তা মনে হয় না। তাদের অর্থনীতি তো সচল রাখতে হবে, আর এত সস্তায় কোনো দেশ থেকে তো শ্রমিক পাওয়া যাবে না।

সব গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা সেই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি। এখানে সংসদেও অর্থবহ আলোচনা হয় না। কারণ, সবাই এক সুরে কথা বলেন। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যকার আলোচনা তাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি; যেখানে সরকারের প্রতিনিধি থাকবেন, বিরোধী দলের প্রতিনিধি থাকবেন, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি থাকবেন, বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যতই ভিন্নমত থাকুক না কেন, পররাষ্ট্রনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) সম্প্রতি এরূপ একটি গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করেছিল। আমি সে সময়ে দেশের বাইরে ছিলাম বিধায় এতে উপস্থিত থাকতে পারিনি। তবে সেই গোলটেবিল বৈঠকের ভিত্তিতে প্রথম আলো একটি পর্যালোচনা প্রকাশ করে। প্রথম আলোর জিজ্ঞাসার জবাবে আমি রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কে আমার বক্তব্য দিয়েছি, যা ওই পর্যালোচনায় বিধৃত হয়। এর আগে বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেও আমি একই কথা বলেছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া প্রতিক্রিয়াটিও পড়েছি।

এ ধরনের আলোচনার উদ্দেশ্য হলো সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে নীতিনির্ধারকদের সহায়তা করা। কিন্তু সমস্যা অস্বীকারের প্রবণতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। সমস্যা যদি স্বীকারই না করা হয়, তাহলে সমাধান কী করে হবে?

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আমার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। তাঁদের মধ্যেঅনেকে আছেন দক্ষ ও উচ্চ পেশাদারি যোগ্যতাসম্পন্ন। সরকারের নির্দেশনায় এ চ্যালেঞ্জগুলো তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে মোকাবিলা করবেন—এ বিশ্বাস আমার আছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে কূটনীতিকেরা হচ্ছেন বিপণনকারী। দেশ যা প্রস্তুত করবে, শুধু তা–ই তাঁরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিপণন করতে পারবেন, তার বেশি কিছু নয়।

মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব