নাজাতের মাস রমজান

রমজান মাস হলো মুক্তির মাস; সকল প্রকার কলুষতা, মলিনতা, আবিলতা ও পাপ–পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে মুক্ত করা বা মুক্ত হওয়াই এই মাসের ব্রত বা সাধনা। রমজান মাসের প্রথম দশক রহমত, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাত, শেষ দশক নাজাত। নাজাত মানে মুক্তি, মুক্তি পাওয়া, মুক্তি দেওয়া, মুক্ত হওয়া। রমজানের শেষ দশকের নাজাতের অর্থ হলো, এই দশকে মানুষ পাপ–তাপ ও গুনাহ থেকে মুক্ত হবে, জাহান্নাম থেকে মুক্ত হবে; পাপের আকর্ষণ থেকে 

মুক্ত হবে। যেভাবে একজন নেশায় আসক্ত বা নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ের নির্দিষ্ট ওষুধ সেবন ও চিকিত্সার মাধ্যমে নেশার আকর্ষণ থেকে মুক্তি লাভ করে থাকে।

মুক্তির মানে হলো নাফসকে ষড়্‌রিপুর মন্দ প্রভাব থেকে মুক্ত করা। মানবসত্তা, অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য—এই ষড়্‌রিপুর সমন্বয়ে গঠিত নাফস বা ব্যক্তিসত্তার তিন অবস্থা। যথা: নাফসে আম্মারা, নাফসে লাউওয়ামা; নাফসে মুতমাইন্নাহ।

নাফসে আম্মারা হলো পাপের প্রতি আকৃষ্ট নাফস বা অবাধ্য সত্তা। নাফসে লাউওয়ামা হলো অনুতপ্ত সত্তা; যে পাপ করে পেশা হিসেবে নয়; নাফসের তাড়নায়, শয়তানের ধোঁকায় বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির শিকার হয়ে এবং লজ্জিত, অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে। নাফসে মুতমাইন্নাহ মানে হলো প্রশান্ত নাফস, যার পাপের প্রতি অনুরাগ থাকে না এবং নেকির প্রতি আকর্ষণ থাকে।

সৃষ্টিগতভাবেই মানুষের মধ্যে ভালো–মন্দ গুণাবলি বিদ্যমান। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর তাকে তার অসত্কর্ম ও সত্কর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সে সফল হলো যে তাকে পবিত্র করেছে; আর সে ব্যর্থ হলো যে তাকে কলুষিত করেছে’ (সুরা-৯১ শামস, আয়াত: ৮-১০)। নাজাতের অর্থ হলো ওই সব দোষত্রুটি থেকে নিজেকে মুক্ত ও পবিত্র করা এবং সৎগুণাবলি অর্জন করে স্থায়ী মুক্তি নিশ্চিত করা। যাতে নাফস মুতমাইন্নাহ অবস্থা থেকে পুনরায় লাউওয়ামা বা আম্মারার দিকে ফিরে না যায়।

নাজাত বা মোহমুক্তির অন্যতম একটি উপায় হলো দূরে সরে যাওয়া বা নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নিয়ন্ত্রিত আচরণ করা। তাই ইতিকাফ নাজাতের চমৎকার একটি মাধ্যম। এতে বান্দা দুনিয়ার সব মোহ–মায়া–আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে একান্তভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর দিকে পালিয়ে আসো’ (সুরা-৫১ যারিয়াত, আয়াত: ৫০)।

পাপ থেকে পাপের অকল্যাণ ও অমঙ্গল থেকে, পাপের ভয়ংকর ভয়াবহ মন্দ পরিণতি থেকে সর্বোপরি পাপের আকর্ষণ ও মোহ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ও মুক্ত হওয়ার জন্যই ইতিকাফ। হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম মহিমান্বিত রজনী শবে কদর প্রাপ্তির জন্য ইতিকাফ। রমজানের বিশেষ সুন্নতে মুআক্কাদা কিফায়া আমল ইতিকাফ। তাকওয়ার রুদ্ধদ্বার প্রশিক্ষণ ইতিকাফ।

ইতিকাফ অবস্থায় ইতিকাফকারী ফরজ ইবাদতের বাইরে আরও নফল ইবাদত করবেন। এতে আরও বেশি ফজিলতের অধিকারী হবেন। যেমন কোরআন মজিদ তিলাওয়াত করা, নফল নামাজ পড়া, কাজা নামাজ আদায়, দোয়া দরুদ পাঠ করা, জিকির আজকার করা, তসবিহ তাহলিল পাঠ করা। এ ছাড়া দ্বীনি আলোচনা ও ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা করাও সওয়াবের কাজ। যেমন কোরআন, হাদিস, ফিকাহ তফসির ইত্যাদি পাঠ করা ও তালিম করা।

ইতিকাফ অবস্থায় এমন সব কথা বলা ও কাজ করা বৈধ, যাতে কোনো গুনাহ নেই। প্রয়োজনীয় সাংসারিক কথাবার্তা বলতেও নিষেধ নেই; তবে অহেতুক, অযথা ও বেহুদা কথাবার্তা দ্বারা ইবাদতের পরিবেশ নষ্ট না করা। ইতিকাফকারী মসজিদের মধ্যে ইতিকাফরত অবস্থায় সুগন্ধি ব্যবহার করতে পারবেন এবং মাথায়, দাড়িতে ও চুলে তেল লাগাতে পারবেন। চুল ও দাড়ি আঁচড়াতে পারবেন। চোখে সুরমাও লাগাতে পারবেন।

ইতিকাফকারী ইতিকাফ অবস্থায় প্রাকৃতিক প্রয়োজনে, তথা অজু এবং খাবার আনার লোক না থাকলে খাবার আনার জন্য মসজিদের বাইরে যেতে পারবেন এবং দ্রুত সময়ে প্রয়োজন সেরে ফিরে আসবেন। মসজিদের বাইরে কারও সঙ্গে কোনো কথাবার্তা বা সালাম বিনিময় করতে পারবেন না; প্রয়োজনীয় কাজ ইশারায় সারতে হবে। (আল হিদায়াহ, আল ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতুহু)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম–এর সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com