প্রবৃদ্ধি দারুণ কিন্তু চাকরিতে খরা

আমাদের দেশে একটা বড় সমস্যা হলো চাকরির অভাব। ডিগ্রি-টিগ্রি ভালো হলেও চাকরি পাওয়া যায় না। আমার জানা দুজন সদ্য পাস ছাত্রী বছরখানেক ধরে চেষ্টা করেও চাকরি পাননি। অথচ নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ-এমবিএ করেছেন। চাকরি নেই। অথবা চাকরিদাতারা যে ধরনের দক্ষতা চান, সেটা মিলছে না। শত চেষ্টা করেও ওঁদের জন্য কিছু করতে না পেরে আমিও সত্যিই অবাক হয়েছি।

তাহলে দেশে যে প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে, সেটা কীভাবে? এমন দারুণ প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে যদি চাকরির সংস্থান না করা যায়, তাহলে প্রবৃদ্ধি দিয়ে কী হবে? এই প্রশ্নের একটি সমাধান আমাদের বের করতেই হবে। না হলে প্রবৃদ্ধির এত উঁচু হার ধরে রাখা কঠিন হবে।

প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে ঢুকছেন। হয়তো দু-চার লাখ চাকরি পাচ্ছেন। বাকিরা বেকার! এটা ঠিক যে সবার জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা যাবে না, আত্মনিয়োজিত চাকরির ব্যবস্থা করার সুযোগ রয়েছে। তাহলে তাঁদের স্টার্টআপ ব্যবসায় আরও অনেকের চাকরির ব্যবস্থা হবে।

এখানে একটা প্রশ্ন ওঠে। দেশের তরুণেরা এত বেকার, তাহলে প্রবৃদ্ধি বাড়ে কীভাবে? এর একটা কারণ হয়তো এই যে আমাদের দেশে অনানুষ্ঠানিক বা নন-ফরমাল চাকরি বেশি। বলা যায়, ৮০ শতাংশই নন-ফরমাল কাজে রয়েছেন। তাঁদের চাকরিরত হিসাবে আনা যায় না। হয়তো ছুটা চাকরি করে কিছু আয় করছেন অনেকে। কিন্তু চাকরি করছেন—এই হিসাবে তাঁদের আনা যায় না। আসলে বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে এ ধরনের সুযোগ বাড়ছে। গিগ-ইকোনমি নামে আধুনিক যে ব্যবস্থা বিশ্বের উন্নত-উন্নয়নশীল দেশে শুরু হয়ে গেছে, সেটা ধরলে হয়তো আমাদের দেশেও বেকারের সংখ্যার চিত্রটা একটু ভালো হবে।

যেমন, এখন এই ঢাকাতেই কয়েক লাখ তরুণ পড়াশোনা বা খণ্ডকালীন চাকরির পাশাপাশি রাইড শেয়ারিংয়ে গাড়ি চালিয়ে রোজগার করছেন। কেউ টিউশনি করছেন। কোনোরকমে চলে যাচ্ছে তাঁদের দৈনন্দিন খরচ। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়।

তাহলে? সমাধানের একটা উপায় হলো তরুণদের বিভিন্ন পেশায় উন্নত মানের দক্ষতা বাড়ানো। দেশে চাকরি থাকলেও দক্ষ কর্মীর অভাবে অনেক উদ্যোক্তা কর্মী পান না। তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ এখন সবচেয়ে বেশি দরকার।

এ বিষয়ে সেদিন প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব বললেন, সরকার কারিগরি শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। একটা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কারিগরি শিক্ষায় ‘সোয়াপ’ বা ‘সেক্টর ওয়াইড প্রোগ্রাম’ কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সোয়াপ হলো এমন একটি পদ্ধতি, যা কোনো একটি খাত বা সেক্টরে সরকার এবং বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর একটি সমন্বিত উদ্যোগ। এর মূল চালকের আসনে থাকবে সরকার এবং অন্য সব সংস্থা তাদের তহবিল তো বটেই, সেই সঙ্গে সবার উদ্যোগ সমন্বিতভাবে কাজে লাগাবে।

এর আগে সোয়াপ কর্মসূচি প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাস্তবায়নের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। সুফল পাওয়া গেছে। এই প্রক্রিয়ায় কাজের ফলে তহবিলের অপচয় কমে, প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ হয়, উন্নত মানের দক্ষতাও নিশ্চিত করা যায়।

আমাদের গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করেছে আইএলও। তাদের কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পোটিআইনেন বলেন, ‘আমাদের দেশের শ্রমবাজারের চাহিদা ঠিকভাবে বের করে সে অনুযায়ী উন্নত মানের দক্ষতা প্রদান নিশ্চিত করা হবে। এ জন্য দরকার এই প্রকল্পে সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। এটা যদি হয়, তাহলে অবশ্যই সুফল পাওয়া যাবে।’

এই দক্ষতা বলতে আমরা কী বুঝি? এটা শুধু বিশেষ কারিগরি বিদ্যায় দক্ষতা নয়। সে তো লাগবেই। আধুনিক বিশ্বে নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানা-বোঝা ও তার প্রয়োগ তো জানতে হবেই। কিন্তু এর পাশাপাশি আরও কিছু জরুরি বিষয়ে দক্ষতা দরকার। যেমন আপনার যদি কমিউনিকেশন স্কিল না থাকে, তাহলে আপনি আধুনিক বিশ্বে অচল। আপনাকে অবশ্যই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কোম্পানি, তাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তা ও প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতে হবে, প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ জন্য ইংরেজিসহ অন্তত আরও একটি বিদেশি ভাষায় অনর্গল কথা বলার দক্ষতা দরকার। দর-কষাকষির দক্ষতা না থাকলে আপনার কোম্পানিকে লস খেতে হবে। তখন কোনো কোম্পানি আপনার কাজে সন্তুষ্ট হবে না, আপনার চাকরিও থাকবে না। তাই এটাও দরকার। দর-কষাকষি একটা আর্ট এবং সায়েন্সও বটে। আরেকটা কথা আছে ইমোশনাল স্কিল। এ বিষয়টা নতুন। আধুনিক প্রতিষ্ঠান চালাতে এই দক্ষতাও দরকার।

আরও কথা আছে। শুধু দক্ষতা অর্জনই নয়। সেটা আন্তর্জাতিক মানের হলো কি না, তার সার্টিফিকেশনেরও ব্যবস্থা থাকবে। সরকার এ বিষয়েও উদ্যোগ নিয়েছে। উন্নত কয়েকটি দেশের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। ওদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যে ধরনের দক্ষতা চায়, তার বাছবিচার করে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র দেওয়া হবে। তাহলে আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে উঁচু পদে চাকরি পাবেন। আর দেশে তো ভালো চাকরির ব্যবস্থা হবেই।

এখন কথা হলো, এত দক্ষতা কে শেখাবে? শেখাবে আমাদের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের সাধারণ প্রবণতা শুধু বিএ-এমএ পাস করা। সেটা নিশ্চয়ই ভালো। উচ্চশিক্ষার দরকার আছে। কিন্তু সবার জন্য হয়তো নেই। তাই শিক্ষাব্যবস্থায় এমন সুযোগ রাখতে হবে, যেন কেউ কারিগরি দক্ষতা অর্জনে ফার্স্ট হবেন, আবার কেউ গ্র্যাজুয়েট-মাস্টার্সে বাজিমাত করবেন। উন্নত দেশগুলোতে এভাবেই শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। কোন শিক্ষার্থী কোন ধারায় বিকশিত হলে সেরা সাফল্য অর্জন করতে পারেন, সেটা স্কুল-কলেজ থেকেই বাছাই করা যায়।

বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নয়ন সহযোগী এবং বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে। হয়তো শিগগির
আমরা বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার দ্বারপ্রান্তে যেতে পারব। এবং এখানে বিফল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, বেকারত্ব নিয়ে ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। আর সেটা না হলে ধারাবাহিক উন্নয়ন ধরে রাখা যাবে না।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]