জয়পুরহাটে চরমপন্থী-বাণিজ্য

গত এপ্রিলে জয়পুরহাটে আত্মসমর্পণকারী ৮০ জন ‘চরমপন্থী’ নিয়ে অভিনব দুর্নীতি উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে কথিত চরমপন্থীদের বিষয়ে যে থলের বিড়াল বেরোল, তাতে এটা পরিষ্কার হলো যে প্রশাসনে সমন্বয় ও সামঞ্জস্যের গুরুতর ঘাটতি রয়েছে। এবং সেই সুযোগে এ ধরনের দুর্নীতি করা সম্ভব হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে জেলা পুলিশ প্রশাসন কেউ এই তালিকা ‘সাজানোর’ দায় নেয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির উচিত হবে এই বিষয়ে একটি উদ্যোগ নেওয়া। তারা চাইলেই সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের সংসদীয় কমিটির সামনে সাক্ষ্য-প্রমাণসহ তলব করতে পারে।

তালিকাভুক্ত চরমপন্থীদের সাতজন ফাঁসির আসামি, যাঁরা কারাবন্দী অথবা পলাতক ছিলেন। একজন বন্দীর কি করে ‘আত্মসমর্পণ’ দরকার পড়ে, সেটা বিরাট প্রশ্ন। চরমপন্থী পরিচয়ে আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আরও আছেন সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী এবং জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা, আছেন বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত থাকা সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মীরা। প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় তাঁরা সবাই এককাট্টা হয়েছেন। এটা তদন্ত করে দেখতে হবে যে এই তথাকথিত চরমপন্থীদের সংখ্যা নিরূপণ করল কারা?

এই কথিত চরমপন্থীরা যে সমাজবিরোধী হিসেবে ১৬টি জেলার জনজীবনে হুমকি ছিলেন, সেটা কী উপায়ে এবং কারা মূল্যায়ন বা চিহ্নিত করল? ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে যে চরমপন্থা রাজনীতির সূচনা করেছিল, সেটা ৫০ বছর পরেও এত বড় সমস্যা হিসেবে টিকে থাকল যে তাদের আত্মসমর্পণের বিষয়টি এতটা জরুরি হয়ে পড়েছিল? বিষয়টি হঠাৎ কার বা কোন সংস্থার নজরে এল? কাদের আগ্রহে চরমপন্থী নীতিমালা প্রণীত করা হলো?

প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনা নির্দেশ করে যে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে সমন্বয়ের এবং সামঞ্জস্যের গুরুতর ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জবাবদিহিমূলক যে ব্যবস্থা জনপ্রশাসনের জীবনী শক্তি, সেটা যেন নিঃশেষিত। পুলিশ সুপার নিজেই বলেছেন, জয়পুরহাটে কোনো চরমপন্থী নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও ৭১ জনের একটি তালিকায় কার্যত তারা সম্মতি দিয়েছেন। এটা সাক্ষ্য দেয় যে সাজানো চরমপন্থীদের সরকারি অর্থ বিলি করার ঘটনা আন্তবিভাগীয় প্রশাসনের জ্ঞাতসারে ঘটেছে। জনপ্রশাসনের শৃঙ্খলার মুখ্য শর্ত হলো, কোনো একটি সংস্থা কোনো সিদ্ধান্তই এককভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে না।

আমরা মনে করি, চরমপন্থী-বাণিজ্যকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটা জনপ্রশাসনের স্বাভাবিক শৃঙ্খলা দুর্বল হয়ে পড়ার অশনিসংকেত। আমরা জানতে চাই, চরমপন্থীরা ওই ১৬ জেলায় ‘অস্বাভাবিক জীবনে’ এমন কী ধরনের নাশকতা করছিলেন, যে জন্য তাঁদের ‘স্বাভাবিক’ জীবনে ফিরিয়ে আনতে মাথাপিছু আত্মসমর্পণকারীকে ১ লাখ ও দলনেতাকে ১০ লাখ টাকা দেওয়া এবং গ্রেপ্তার হওয়া বা কারাগারে থাকা ব্যক্তিদের ‘চরমপন্থী’ হিসেবে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। চরমপন্থী-বাণিজ্যের কাহিনি পর্যালোচনায় এটা সন্দেহ করার কারণ আছে যে সন্ত্রাসী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একটি শক্তিশালী আঁতাতের ফসল এই উপাখ্যান। এতে পুলিশ, গোয়েন্দা, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতা—সবাই কমবেশি জড়িত। এই ঘটনা নীরবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অপরাধ ছড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত দেয়। এ ধরনের পদ্ধতিগত অপরাধ শুধু জয়পুরহাটকেন্দ্রিক, তা মনে করার কারণ নেই।

জয়পুরহাটের আওয়ামী লীগ ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতাদের ধন্যবাদ যে তাঁরা অকপটে স্বীকার করেছেন তাঁদের এলাকায় কোনো চরমপন্থী ছিল না। বরং কেউ কেউ অভিযোগ এনেছে যে স্থানীয় সাংসদ জড়িত, যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উচিত হবে সর্বাগ্রে দলীয় সম্পৃক্ততা তদন্ত করা। আর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির উচিত হবে পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা এবং তার ফলাফল প্রকাশ করা। দোষীদের শাস্তি চাই।