রমজানের শিক্ষা মানবিক, ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতা

মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকাশে সহায়ক রমজান। রোজা পালনের মাধ্যমে ধনীরা গরিবের দুঃখ বুঝবে; ক্ষুৎপিপাসার জ্বালা অনুভব করবে। বুঝতে পারবে অসহায় নিরন্ন মানুষের ও খাদ্যের সম্মান। মর্যাদা দিতে শিখবে ক্ষুধার্ত মানুষকে। উপলব্ধি করবে, কেন অন্নহীন গরিব মানুষ একমুঠো খাবারের জন্য অন্যের দ্বারে হাত পাতে। অনুধাবন করবে দুস্থ–গরিব লোকেরা ধনী হওয়ার লোভে নয়, সম্পদের নেশায় নয়, ভোগবিলাসের মোহে নয়, শুধুই জীবন বাঁচানোর তাগিদে সবার অগোচরে দৃষ্টির আড়াল হলে সামান্য বাসি–ঝুটা খাবারের প্রতি হাত বাড়ায়। কেন গরিব মা তাঁকে খেতে দিলে নিজে না খেয়ে আঁচলে বেঁধে নেয় তাঁর অভুক্ত সন্তানের জন্য। অনুভব করে ক্ষুধায় কাতর মানুষ কেন তার আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়, মর্যাদা ভুলে যায়, মান–ইজ্জত বিকিয়ে দেয় খাবারের জন্য। তাদেরকে ঘৃণা ও উপেক্ষা নয়, তাদের জন্য ভালোবাসা ও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। এটুকু অনুভূতি জাগ্রত হওয়াই রোজা ও রমজানের বড় শিক্ষা।

জাকাত একটি ফরজ ইবাদত। জাকাত করুণার দান নয়, দয়া–দাক্ষিণ্যও নয়। এটি বঞ্চিতদের পাওনা অধিকার। আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেছেন, ‘তাদের সম্পদে বঞ্চিতদের নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে’ (সুরা-৫১ যারিয়াত, আয়াত: ১৯; সুরা-৭০ মাআরিজ, আয়াত: ২৪-২৫)। পাওনাদারের টাকা দিয়ে পাওনাদারকে নিম্নমানের কিছু কিনে দেওয়া ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কী?

কোরআন করিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত কল্যাণ পাবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় জিনিস দান করবে। আর তোমরা যা দান করো, আল্লাহ সে বিষয়ে অবগত’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৯২)। যেহেতু এটি তার পাওনা, সুতরাং প্রাপককে তার পাওনা সসম্মানে প্রদান করতে হবে; যাতে তিনি তা পেয়ে সন্তুষ্ট হন। জাকাত প্রদান করা ফরজ ও সদকা আদায় করা ওয়াজিব; কিন্তু কোনো মানুষকে হেয় জ্ঞান করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, কারও সম্মানহানি করা নাজায়েজ ও হারাম কাজ।

রমজানে সমাজের অবহেলিত–বঞ্চিত মানুষের জন্য দান–খয়রাত, ফিতরা–জাকাত ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কখনো কখনো এ মহতী কাজেও অনেকে ভুল পদক্ষেপ নেন। রমজান এলে কোথাও কোথাও দেখা যায়, অনেক কাপড় ব্যবসায়ী অসম্মানজনকভাবে জাকাতের কাপড় বিক্রির ব্যানার ঝুলান। বিজ্ঞাপন দিয়ে কিছু কম দামি নিম্নমানের শাড়ি, কাপড় ও লুঙ্গি বিক্রয় করেন। কোনো কোনো জাকাতদাতাও এমন আছেন, যাঁরা এগুলো কিনে জাকাত হিসেবে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করেন। যাঁরা এসব করেন, তাঁরা প্রথমত জাকাতকে অসম্মান করেন, দ্বিতীয়ত জাকাতদাতাকে হীন কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন; যা অনধিকার চর্চা ও অনৈতিক।

হাদিস শরিফে আছে, মন্দ কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী অনুরূপ মন্দ কাজের সমান প্রতিফল পাবে এবং ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদানকারী সেইরূপ ভালো কাজ করার সমান সুফল পাবে। যেসব জাকাতদাতা এ ধরনের নিম্নমানের শাড়ি, লুঙ্গি জাকাত হিসেবে দিচ্ছেন, তাঁরা একদিকে জাকাতকে অসম্মান করছেন, অন্যদিকে জাকাতগ্রহীতাকেও অমর্যাদা করছেন।

সব মিলিয়ে ইসলামের পঞ্চভিত্তির অন্যতম খোদায়ী বিধান জাকাতের অবমাননা হচ্ছে আর মানবতার সঙ্গে উপহাস করা হচ্ছে, সর্বোপরি ইমান ও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ একটি মৌলিক ইবাদতে ছলচাতুরীর মাধ্যমে খেল-তামাশায় পরিণত করা হচ্ছে। রমজানের মূল লক্ষ্য মানব ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা থেকে বঞ্চিতই রয়ে যাচ্ছে।

সদকাতুল ফিতর, জাকাত ও যেকোনো ফরজ ওয়াজিব সদকা, যা নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করতে হয় এবং যেসব শুধুই গরিবের হক; সেসব প্রদান করার ক্ষেত্রে গ্রহীতাকে এমন বলার প্রয়োজন নেই যে ‘এটা জাকাত’ বা ‘এটা ফিতরা’। এমনভাবে না বলাই উচিত; কেননা এতে গ্রহীতা লজ্জিত, অপমানিত ও সংকোচ বোধ করবেন। শুধু ফরজ ওয়াজিব দান নয়, বরং নফল দান–খয়রাতের মাধ্যমেও কাউকে অসম্মান করা যাবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘উত্তম কথা ও ক্ষমা সেই দান অপেক্ষা উত্তম, যার সঙ্গে অনুগামী হয় যন্ত্রণা। আর আল্লাহ তাআলা ধনী ও সহিষ্ণু’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৬৩)।

সদকা ও জাকাত এমনভাবে দেওয়া উত্তম, যা গ্রহীতা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে মুদ্রা বা টাকাই অগ্রগণ্য, কেননা এর দ্বারা গ্রহণকারী নিজের রুচি ও ইচ্ছামতো প্রয়োজন মেটাতে পারেন। কোনো কাপড়চোপড় বা খাদ্যদ্রব্য অথবা অন্য কোনো বস্তু কিনে দিলে ব্যবহার উপযোগী মানসম্পন্ন জিনিসই দেওয়া উচিত।

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক