বৈষম্যের উন্নয়নে ধানের দাম

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের গাড়ি দেওয়ার অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী মো.আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, দেশের উন্নয়ন হয়েছে বলেই কৃষক ধানের দাম পাচ্ছেন না। খবরটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হলেও অধিকাংশ সংবাদপত্রের ভেতরের পাতায় কোনোমতে একটুখানি জায়গা পেয়েছে। অনেক কাগজে কোনো জায়গাই পায়নি। পাবে কী করে, চারদিকে এত মুখরোচক ও উত্তেজক খবরের ছড়াছড়ি!

শুধু ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়েই যত খবর হয়েছে, তার খসড়া তালিকা করলে দাঁড়াবে এই: ১. নতুন কমিটিতে পদ বিক্রির অভিযোগ; ২. শিবির কর্মীর কমিটিতে পদ লাভ; ৩. পদবঞ্চিতদের সংবাদ সম্মেলনে হামলার কারণে মধুর ক্যানটিনে মারামারি; ৪. অতীতে অন্য সংগঠনের ছাত্রীকে প্রায় বিবস্ত্র করার মতো অপরাধে অপরাধীর নিজ দলের কমরেডদের হাতে মার খেয়ে আহত হওয়া; ৫. কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় রাতের বেলায় হলের বাইরে বিক্ষোভ করায় সাধারণ ছাত্রীরা তিরস্কৃত হলেও ছাত্রী হলের নেত্রীদের গভীর রাতে টিএসসিতে আপসরফার বৈঠকে গিয়ে লাঞ্ছিত হওয়া; ৬. রাতের বেলায় রাজু ভাস্কর্যে পদবঞ্চিতদের অবস্থান ধর্মঘট; ৭. টিভি চ্যানেলে ও ফেসবুকে ছাত্রলীগ নেতাদের ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে সহযোগী নেত্রীদের নানা অভিযোগ; ৮. আওয়ামী লীগের নেতাদের হস্তক্ষেপ ও সমস্যা সমাধানের আশ্বাস; এবং ৯. সর্বসম্প্রতি বহিষ্কৃত একজন ছাত্রলীগ নেত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টা।

প্রতিপক্ষদের ঠেঙাতে অভ্যস্ত হাতগুলো যখন নিশপিশ করে, তখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না থাকলে নিজেদের ওপরই শক্তিপ্রয়োগের চর্চা বজায় রাখার প্রয়োজন হয়। না হলে হাত-পায়ে জং ধরার আশঙ্কা তৈরি হয় বলেই এ সাংগঠনিক বিবাদের উপকারিতা অস্বীকার করা যাবে না। এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে ডাকসুর ভিপিকে ‘ধাক্কাধাক্কি’ এবং ইফতার খাওয়ায় বাধা দেওয়া । তা ছাড়া ফেসবুক খ্যাতির যুগে কৃষকের খরচ কমানোর নামে শহর থেকে যাওয়া ছাত্রলীগ নেতারা ধানের শিষ হাতে ছবি প্রকাশই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন?

কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য ও উপজেলা পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের সরকারি গাড়ি দেওয়ার খবরটিতে বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন দর্শনের নিখুঁত প্রতিফলন রয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের সরকারি গাড়ি উন্নয়নের প্রতীক। এসব গাড়ি দিয়ে বোঝানো যায় যে গ্রামাঞ্চলেও অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে, গাড়ি চালানোর মতো রাস্তা হয়েছে, তা সেই রাস্তা যত খারাপ অথবা ভাঙাচোরাই হোক না কেন। সরকারি কর্মকর্তাদের কৃষির উন্নয়নে মাঠপর্যায়ে আরও সচল ও সক্রিয় করতে সরকার যে উদ্যোগী, তেমন একটি ধারণাও এতে তৈরি করা সহজ হবে, আসল উদ্দেশ্য যদি আমলাদের খুশি করাও হয়।

মন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট, এ উন্নয়ন দর্শনে কৃষির উন্নয়ন মানে কৃষকের উন্নয়ন নয়। তাঁর কথায় উন্নয়নের কারণে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু ফলন ভালো হলেও তা বেচে চাষের খরচ না ওঠায় কৃষক যে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন, তাতে কারও কিছুই আসে-যায় না। কৃষকের সুরক্ষা সরকারের অগ্রাধিকারের বিষয় হলে হতাশাগ্রস্ত কৃষক যখন মাঠের ধানে আগুন লাগিয়েছেন, তখন কৃষির উন্নয়নের নামে আমলাদের জন্য শত শত গাড়ি হস্তান্তর নিষ্ঠুর তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। কৃষিবিদ কৃষিমন্ত্রী ফলন বৃদ্ধি, উন্নত চাষাবাদ, বীজ-সার-কীটনাশকের মতো বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতেই পারেন এবং এগুলোর ব্যবস্থাপনায় উৎসাহিত করতে কৃষিবিদদের প্রণোদনাও দিতে পারেন। কিন্তু কৃষক যদি ফলনের দাম না পান, তাহলে এসব আয়োজন তো অর্থহীন। তখন তো চাষাবাদ ছেড়ে দেওয়াই তাঁর জন্য ভালো।

উন্নয়নের এ নতুন দর্শনে কৃষিমন্ত্রীর চেয়ে সম্ভবত এগিয়ে আছেন খাদ্যমন্ত্রী। নইলে কৃষকের ক্ষোভকে তাঁর নাশকতা মনে হওয়ার কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? ১৫ মে সিরাজগঞ্জে সরকারিভাবে বোরো সংগ্রহ অভিযান উদ্বোধনের সময় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘সরকারকে বিপর্যস্ত ও বিব্রত করতে একটি অশুভ চক্র কৃষকদের উসকানি দিয়ে ধানের জমিতে আগুন দিয়েছে।’ মন্ত্রী হওয়ার আগে তাঁর পেশাগত পরিচয় ছিল ব্যবসায়ী হিসেবে। তাঁর সেই সময়ের মূল ব্যবসা খাদ্যদ্রব্যের, সুনির্দিষ্টভাবে বললে ধানের ব্যবসা। এ ব্যবসার ভেতর-বাইরের সবকিছু তাঁর নখদর্পণে থাকার কথা। সরকারি ধান কেনার প্রক্রিয়ায় কৃষকেরা যে কত অসহায় এবং এ ব্যবস্থার পুরো সুবিধাটা যে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা (ধানকল ও চাতালের মালিক) পেয়ে থাকেন, সেটা তাঁর অজানা থাকার কথা নয়।

তা ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশে এ প্রক্রিয়ায় কীভাবে দুপয়সা কামিয়ে নেন, সেটাও কোনো নতুন তথ্য নয়। সম্ভবত সে কারণেই তিনি ওই অনুষ্ঠানে বলেছেন যে সরকারি দলের লোকজন কোনো ঝামেলা করবেন না। অথচ একজন ইউএনও ও একজন জেলা প্রশাসকের উদ্যোগী হয়ে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা ব্যতিক্রম হিসেবে সংবাদ হয়েছে। অন্য সব জায়গায় কৃষকেরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ধান ক্রয়ের সরকারি লক্ষ্যমাত্রা মোট উৎপাদনের দশ শতাংশেরও কম হওয়ায় বাজার চাঙা করার জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। ঋণখেলাপিদের সুদ মওকুফের জন্য রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকার সংস্থান করা গেলেও কাদামাখা কৃষকের ক্ষতি পোষানোর ব্যবস্থা করার সামর্থ্য আমাদের নেই।

ঈদে সন্তানের চাহিদা মেটাতে পারবেন না বলে পাবনার ভাঙ্গুরায় যে অভাবী কৃষকের আত্মহত্যার খবর দিয়েছে ইত্তেফাক (২১ মে), আমার আশঙ্কা, তাকেও না শেষ পর্যন্ত নাশকতা বলা হয়। পাঁচ বছর আগে একজন মন্ত্রী নতুন মন্ত্রিসভায় জায়গা না পাওয়ায় টিভি ক্যামেরার সামনেই কেঁদে ফেলেছিলেন, কারণ তাঁর স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল। যে কৃষক ধান চাষ করেছেন, তাঁর স্বপ্ন ভেঙে গেলে প্রতিক্রিয়াটা কী হওয়া উচিত, তা নিশ্চয়ই কাউকে বলে দিতে হবে না।

সরকার কৃষকদের উৎপাদন খরচের ওপরে নির্ধারিত দামে ধান-চাল কিনলে বাজারে ধান-চালের দাম বাড়ে। ফলে এ পদ্ধতি অনেক দিন ধরেই চালু আছে। কিন্তু এবারের সমস্যা জটিল হওয়ার কারণ: ১. প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ভালো ফলন ২. সরকারের অপ্রয়োজনীয় আমদানি; ৩. অতীতের মজুত ব
্যবহৃত না হওয়ায় গুদাম না থাকা; ৪. মধ্যস্বত্বভোগী চাতাল-ধানকলের মালিকদের সংঘবদ্ধ দৌরাত্ম্য; এবং ৫. ধান সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের কমিশন-বাণিজ্য। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার মূল কারণ অস্বাভাবিক মাত্রায় আমদানি। নির্বাচনের বছরে বিদেশে টাকা পাচার অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যাওয়ার যে দৃষ্টান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে, তার আলোকে গেল মৌসুমে চাল আমদানিতে উৎসাহের একটা ব্যাখ্যা মেলে। ফলে অল্প কয়েকজন আমদানিকারক আর কিছু মধ্যস্বত্বভোগীর সমৃদ্ধির বিপরীতে লাখ লাখ কৃষকের দুর্ভোগ বাড়া ছাড়া কমার কথা নয়।

ভারতে গত বছর এবং এ বছরের গোড়ায় কৃষকদের অভূতপূর্ব জাগরণ দেখা গিয়েছিল। বছরখানেকের মধ্যে অন্তত পাঁচবার সেখানকার কৃষকেরা মুম্বাই ও দিল্লির উদ্দেশে দীর্ঘ পদযাত্রা করেছিলেন। মুম্বাইতে ছিল রাজ্য পর্যায়ের আন্দোলন। আর দিল্লিতে ভারতজুড়ে আন্দোলন। কৃষকদের দাবিগুলোর মধ্যে ছিল ফসলের ন্যূনতম দাম নির্ধারণ, কৃষিঋণ মওকুফ, খরার মোকাবিলায় বিশেষ সহায়তা ইত্যাদি। গণতন্ত্রে যা হয়, ভারতে তাই হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো কৃষকদের দাবিগুলোর দিকে নজর দিতে বাধ্য হয়েছে। কৃষকদের দেনা মওকুফের অঙ্গীকার করে কংগ্রেস মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে সরকার গঠনে সফল হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনেও কংগ্রেস একই অঙ্গীকার করেছে। ক্ষমতাসীন বিজেপি নির্বাচনের আগে স্বীকার করেছে যে কৃষক আন্দোলন তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে।

বাংলাদেশে চিত্রটা একেবারেই আলাদা। গণতন্ত্রের নাজুক অবস্থায় এমনকি বামপন্থীরাও কৃষক আন্দোলনের সামর্থ্য হারিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মন্দ ঋণ অবলোপন, ঋণখেলাপিদের বকেয়া সুদে ছাড় এবং সুবিধাভোগী বিভিন্ন ব্যবসায়িক খাতে নানা ধরনের কর রেয়াতে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার সুবিধা দিতে পারলে বিপন্ন কৃষকদের সুরক্ষা দিতে এত অনীহা কেন? উত্তরটা জানা থাকলেও তা বলতে পারার সাহসটা সম্ভবত হারিয়ে গেছে। সরকারের উন্নয়ন দর্শনে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থ প্রধান নয়, মুষ্টিমেয়ই প্রধান। সে কারণে দেশে বৈষম্য বেড়েই চলেছে। খেতের ধানে আগুন লাগানো কি বৈষম্যের উন্নয়নকেই নাকচ করছে না?


কামাল আহমেদ সাংবাদিক