বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস

বহু বছর বন্ধ থাকার পর সরকার আবার দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস চালুর যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা আশাবাদ সৃষ্টির চেয়ে শঙ্কাই বাড়িয়ে দেয়। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস খোলার লক্ষ্যে সরকার তিন সদস্যের একটি কমিটিও করে দিয়েছে। এর সুপারিশের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব।

এখানে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয় যে দেশে অর্ধশতাধিক সরকারি ও ১০৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে কেন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস খোলার প্রয়োজন হলো? সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মান ধরে রাখতে পারছে না। এমনকি তারা সরকারের শর্তও মেনে চলছে না। সাম্প্রতিক একটি জরিপেও দেখা গেছে, ১০৪টির মধ্যে মাত্র ২০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মোটামুটি মান রক্ষা করে চলেছে।

ইউজিসি বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে কার্যক্রম চালানো ৫৬টি বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছিল। বর্তমানে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস না থাকলেও অবৈধভাবে কিছু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমও নানা কৌশলে চলছে। ২০১৪ সালের মে মাসে ‘বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনা বিধিমালা-ছক’ জারি করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর ২০টির বেশি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার চালুর আবেদন করলেও তখন অনুমতি দেওয়া হয়নি। যুক্তি দেখানো হয় যে আগের বিধিমালায় যেনতেন বিশ্ববিদ্যালয় এখানে শাখা খুলতে পারত। এখন বিধিমালাটি কঠোর করা হবে। কিন্তু সেই কঠোর নীতিমালা যে প্রতিপালিত হবে, তার নিশ্চয়তা কী।

বিধিমালা অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাসের সাময়িক অনুমোদনের জন্য নিজস্ব অথবা ভাড়া করা ভবনে কমপক্ষে ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গা থাকতে হবে এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর স্থানসংকুলান হয়, এমন পর্যাপ্ত পরিমাণ শ্রেণিকক্ষ থাকতে হবে। স্টাডি সেন্টারের জন্য নিজস্ব অথবা ভাড়া করা ভবনে কমপক্ষে ১০ হাজার বর্গফুটের জায়গা থাকতে হবে। কিন্তু যোগ্য শিক্ষক পাওয়া যাবে কোথায়? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে একসময় রমরমা সনদ–বাণিজ্য চলেছে। এখন সেটি কমলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। তবে বিধিমালায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় এককভাবে বা স্থানীয় প্রতিনিধি অথবা দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তা যৌথভাবে শাখা খুলতে পারবেন বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যেই আসল রহস্য আছে বলে ধারণা করার যথেষ্ট কারণ আছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই সম্ভবত স্থানীয় প্রতিনিধিত্বের নামে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খুলে বসবেন, যেমনটি হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে।

বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস খোলার নামে সনদ-বাণিজ্য হোক, সেটি কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। সরকারি বা বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান সন্তোষজনক নয়। অনেক দেশেই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা আছে। কিন্তু কী ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় এখানে শাখা খুলবে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। অখ্যাত বা কম খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শাখা খোলা হলে তা কোনোভাবে উচ্চশিক্ষার মান বাড়াবে না। বরং সনদ-বাণিজ্যের নামে তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেবে। অতএব, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা উচিত।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস খোলার বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার শর্তগুলোও কম কঠোর নয়। কিন্তু সরকার তা কোনোভাবে মানাতে পারছে না। নিয়ম না মানা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের যাঁরা মালিক, তাঁদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলের এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস খোলার ক্ষেত্রেও যে এর ব্যতিক্রম হবে না, তা হলফ করে বলা যায়।