৬ মাসে আধা ডজন মামলার নিষ্পত্তি?

সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের আওতায় হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের প্রতি আরও একটি নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। নিম্ন আদালতকে এখন বিচার সম্পন্ন করতে বেঁধে দেওয়া সময় মানতে হবে। না পারলে তার কৈফিয়ত দিতে হবে। চুপচাপ আদেশ অগ্রাহ্য করা যাবে না। কেউ করলে তাকে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায় নিতে হবে। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নিম্ন আদালতগুলোকে হাইকোর্ট নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করবে। হাইকোর্টের এটি বিশেষ প্রশাসনিক ক্ষমতা। এই অনুচ্ছেদটি দীর্ঘকাল অনেকটাই অকার্যকর ছিল। এর বরাতে ইদানীং হাইকোর্টের আদেশ বাড়ছে। বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩০ লাখ থেকে ৪০ লাখ হতে চলেছে—এই বাস্তবতায় হাইকোর্ট বিভাগ ক্রমেই যে তঁার এখতিয়ার অধিকতর কার্যকর করতে উদ্যোগী হচ্ছেন, এটা খুবই ভালো দিক।

হাইকোর্ট অনেক মামলার বিচার সম্পন্ন করতে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেন। কিন্তু এটা বলে দেন না যে, নিম্ন আদালত যদি তা না মানেন বা অপারগ হন, তাহলে তার ফলাফল কী হবে। গত ৮ এপ্রিল বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বিএনপি নেতার এক মামলায় যে রায় দিয়েছিলেন, আমরা এখন তার পূর্ণাঙ্গ রায়টি পেলাম। তাতেই আমরা একটি দরকারি বিষয় পেলাম, যার ঘাটতি চলছিল। এই একটি নির্দেশনা যদি সারা দেশে কার্যকর করা সম্ভব হয়, তাহলে তা বিচারাধীন মামলার জট কমাতে এবং সবচেয়ে বড় কথা একটি মৌলিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

মামলার শুনানি শুরু হওয়ার পরেও মামলার শুনানি মুলতবি রাখার আরজি জানাতে খোঁড়া অজুহাতের কমতি কখনো ঘটেছে বলে জানি না। তবে এটা সবারই জানা যে নির্ধারিত সময়ে বিচার শেষ না করা একটি রোগে পরিণত হয়েছে। অবশ্য ন্যায়বিচার করা নিয়ে যে কোটি টাকার প্রশ্ন আছে, সেটিও আমরা মনে রাখব। আমরা যখন গায়েবি মামলার কথা জানি, তখন তার বিচার নির্দিষ্ট সময়ে না হয়ে সেটা স্থগিত হলে আমরা স্বস্তি পাই। কিন্তু আসলে যা হওয়া উচিত তা হচ্ছে এসব গায়েবি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি। কারণ, স্বাধীন বিচার বিভাগের কাছ থেকে আমরা সেই রায় পাব, যেখানে গায়েবি মামলার আসামিরা শুধু খালাস পাবেন, তা–ই নয়, ভুয়া মামলা করার জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের শাস্তিও হবে। ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ দিতে রাষ্ট্রকে নির্দেশ দেবেন।

বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদ এক–এগারোতে তাঁর বিরুদ্ধে করা সম্পদের অসংগতি মামলার বিচার কার্যক্রম যাতে না চলে সে জন্য হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। গত ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি তাঁর আয়কর মূল্যায়ন (২০০২-৮) মামলার শুনানিতে অংশ নেন। তখন তিনি হাইকোর্টে দায়ের করা তঁার ৯টি রিট মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম স্থগিত রাখার আরজি পেশ করেন। এই মামলায় আদালত একটি মূল্যবান পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। হাইকোর্ট বলেছেন, ‘নিম্ন আদালতের বিচারকদের অনেকের মধ্যে ধারণা আছে যে হাইকোর্ট যেখানে কোনো আদেশ মানতে সময়সীমা বেঁধে দেন অথচ সেটা মানতে না পারলে কী হবে, তা বলে দেন না, তাই সেসব আদেশ নির্দেশনামূলক, বাধ্যতামূলক নয়। এই ধারণা ভুল।’ হাইকোর্ট বলেছেন, ‘আদেশ মানতেই হবে। সময়সীমা মানতে না পারলে যথাযথ কারণ ব্যাখ্যা করে হাইকোর্টকে অবগত করতে হবে। কিন্তু নীরব থাকলে বিভাগীয় শাস্তিমূলক মামলার মুখোমুখি হতে হবে।’ এখানে আমরা স্মরণে রাখব, অনেক আইনেই সময়সীমা বাঁধা আছে। যেমন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালকে ৯০ দিনের মধ্যে বিচার, না পারলে সুপ্রিম কোর্টের কাছে কারণ দর্শিয়ে প্রথমে ৩০ দিন ও পরে আরও ১৫ দিনে বিচার শেষ করার বিধান করা হয়েছিল। আইনটির মেয়াদ বাড়ছে। কিন্তু ওই বিধান কাজ দিচ্ছে না। এখানেও তদারকি দরকার।

এক-এগারো আমলে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলার দ্রুত বিচার আশা করা হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে আশা পূরণ হয়নি। তবে এই উদাহরণ তৈরি হয়েছে যে প্রভাবশালীদের দুর্নীতির মামলার বিচার প্রলম্বিত হতে পারে। প্রভাবশালীরা তিন ভাগে বিভক্ত। যঁারা মিথ্যা বা রাজনৈতিক মামলা বলে তা প্রত্যাহার করাতে পেরেছেন, তঁারা প্রথম দলে। দ্বিতীয় দলে আছেন সরকারে যোগ দেননি, অথচ সরকারি মহলের নেক নজরে আসতে পেরেছেন। তৃতীয় দলে আছেন যাঁরা নেক নজরে নেই, বিরোধী অথচ প্রভাবশালী। শেষের দুই দলের মধ্যে একটা মিল আছে, তারা বিচার–প্রক্রিয়ার গতি স্তিমিত রাখতে সক্ষম।

‘মিথ্যা’ বা হয়রানিমূলক মামলা থেকে পরিত্রাণের দুটো উপায়। সরকারকে দিয়ে মামলা তুলে নেওয়া। অন্যটি হলো দ্রুত বিচার করে নিজেকে আদালতে নির্দোষ প্রমাণ করা। কোনো মামলার মূল বিচার করে নিম্ন আদালত। তাই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সবচেয়ে বড় জায়গা বিচারিক আদালত। কিন্তু যুগে যুগে দেখা যায়, প্রভাবশালীদের কেউ এটা হতে দিতে চান না। তাঁরা এ জন্য যেসব উপায় অনুসরণ করেন তা হলো, নিম্ন আদালত যাতে বিচারই করতে না পারেন, সে জন্য আইনি বাধা তৈরি করেন। শুনানির একটি তারিখ থেকে পরের তারিখ যত বেশি লম্বা করা যাবে, তত বেশি দায়মুক্তির সুবিধা।

 নিম্ন আদালতকে বিচার করতে না দেওয়ার প্রধান যুক্তি হলো, নিম্ন আদালত সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। জামিন পেতে হাইকোর্ট চত্বরে উপচে পড়া ভিড়, সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের পরে একটা পরিবর্তন আশা করা হয়েছিল। ভেবেছিলাম, উচ্চ আদালতই বিচারপ্রার্থীদের নিম্ন আদালতে যেতে সর্বতোভাবে উৎসাহিত করবে। সেই ধারাটা বেগবান হয়নি। তবে হাইকোর্টের সর্বশেষ আদেশ যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তবে এক-এগারোরসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকগুলো মামলার বিচার আমরা ২০১৯ সাল শেষ হওয়ার আগেই আশা করতে পারি। এই মামলাগুলোর মধ্যে খালেদা জিয়ার গ্যাটকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি, মির্জা আব্বাসের সাংবাদিকের প্লট বরাদ্দ, শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর সম্পদের মামলা আছে। আছে হাল আমলের হল–মার্ক ও ডেসটিনি। এই আধা ডজন মামলা নিষ্পত্তিতেই ছয় মাসের সময়সীমা বেঁধেছেন হাইকোর্ট।

আশা করব, এই বিশেষ মামলাগুলোর বিচার ছয় মাসে শেষ করে একটা নতুন উদাহরণ তৈরি হোক। যদিও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে জনমনের জিজ্ঞাসা জিইয়ে রেখে এই সময়সীমা মেনে চলার কঠোরতা বিষয়ে একটা খটকা থেকেই যাবে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]