'বিপজ্জনক' ছুটিতে শিশুরা ঝুঁকিতে

এমন উচ্ছলতা থেকেই ঘনিয়ে আসতে পারে বিপদ। ছবি ফারুক ওয়াসিফ
এমন উচ্ছলতা থেকেই ঘনিয়ে আসতে পারে বিপদ। ছবি ফারুক ওয়াসিফ

ছুটিতে গিয়ে আমাদের অবহেলায় অনেক শিশুর একেবারেই ছুটি হয়ে যায়। চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ের আদিত্য শীল (৪), দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের লাম-আলিফ (৪), জয়পুরহাটের পাঁচবিবির মরিয়ম (৪), পাবনার চাটমোহরের রাজীব হোসেন (দেড় বছর) ও রাতুল (৩), চুয়াডাঙ্গার মোহনা খাতুন (৮) ও রিপন (৯), লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের আয়ান আলমগীর, নোয়াখালীর সেনবাগের শিপাত (৬), দিনাজপুরের বীরগঞ্জের যমজ ভাই হাচেন-হুচেন (২), রাজবাড়ীর দুই বোন মিম ও সুমাইয়া এবং আশরাফুল (২), ইন্দোনেশিয়ার বালিতে ঢাকার নাওয়ার, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের রূপম চন্দ্র (৫)। তালিকাটা আরও লম্বা, শেষ নয় এখানেই। এরা কেউ আর বাড়িতে মায়ের কোলে, বাবার কাছে ফিরবে না কোনো দিন।

এরা সবই মায়ের সঙ্গে ছুটি কাটাতে গিয়েছিল গ্রামের বাড়ি, নানার বাড়ি বা দূর দেশে। সবার সঙ্গেই মা ছিলেন। কিন্তু কোনো এক ফাঁকে বাড়ির লাগোয়া কোনো ডোবায়, পুকুরে বা নদীতে পড়ে মারা গেছে অকালে। শিশুরা এখন রোগ-ব্যাধিতে আর আগের মতো ঝরে পড়ে না। শিশুমৃত্যুর এখন প্রধান কারণ দুর্ঘটনা, আর দুর্ঘটনা মধ্যে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনাই প্রধান। বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দেশে প্রতি ৩০ মিনিটে একটি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। দিন শেষে মৃত শিশুর সংখ্যা দাঁড়ায় কমপক্ষে ৫০। এতে আরও বলা হয়, প্রতিবছর ১ থেকে ১৭ বছর বয়সী কমপক্ষে ১৮ হাজার শিশু মারা যায় কেবল পানিতে ডুবে। আর মারা যাওয়া বেশির ভাগ শিশুর বয়স ১০ মাস থেকে ২ বছরের মধ্যে। দুর্যোগ ফোরাম সারা বছরের পানিতে ডুবে মারা যাওয়া শিশুদের প্রকাশিত খবরের বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, সারা বছর পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।

দিনক্ষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, পানিতে ডুবে মারা যাওয়া শিশুদের একটা বড় অংশ (প্রায় ৫৫ শতাংশ) ঈদ বা অন্য কোনো বড় ছুটিতে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। অনেক সমবয়সীকে একসঙ্গে পেয়ে মাতোয়ারা হয়ে দারুণ কিছু একটা করে দেখানোর ঝোঁকে পড়ে। সেই ঝোঁক যেকোনো দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে, দেয়ও। পত্রিকা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, গত ঈদুল ফিতরের ছুটিতে যে ৩৬ জনের পানিতে ডুবে মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছিল, তার মধ্যে ৩২ জনই ছিল শিশু। এদের অনেকেই ডুবেছে একসঙ্গে—দু–তিনজন আপন বা মামাতো খালাতো কি চাচাতো ভাইবোন। এদের মধ্যে কেউ একজন হয়তো সাঁতার জনত। একজনকে হাবুডুবু খেতে দেখে অন্যেরা একে একে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু সাঁতার জানা আর ডুবন্ত মানুষকে বাঁচানোর কৌশল যে এক জিনিস নয়, তা আমরা জানি কয়জন।

আবার অনেক সময় শিশুদের মধ্যে যারা সাঁতার জানে বা যারা একটু বড়, তারা সাঁতার না জানা ছোটদের পাড়ে বসিয়ে নেমে যায় পুকুরে। পাড়ে বসে থাকতে থাকতে একসময় তারাও নেমে পড়ে পাড়ের কাছাকাছি জলে। সাঁতার জানারা খেয়াল করে না বা ভুলে যায় তাদের কথা। এমনটিই ঘটেছে চার বছরের শিশু মরিয়মের ক্ষেত্রে। পাঁচবিবিতে নানাবাড়ি বেড়াতে আসা শিশুটি গত ২ মে অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গোসল করতে পুকুরে গিয়েছিল। গোসল করে অন্যরা পানি থেকে উঠে আসার সময় পাড়ের কাছে পুকুরের পানিতে ডুবে থাকা মরিয়মের শরীর তাদের পায়ে লাগে। এ সময় শিশুদের চিৎকারে লোকজন এগিয়ে এসে পুকুর থেকে তাকে উদ্ধার করে দ্রুত মহিপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তবরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কবিখালী গ্রামে মামাতো–ফুফাতো ভাইবোন রিপন (৯) আর মোহনা খাতুন (৮) গত মে ৬ একসঙ্গে ডুবে মারা যায় বাড়ির কাছে একটা ডোবায়। মায়ের সঙ্গে কবিখালী তার মামার বাড়িতে বেড়াতে আসা রিপন সকালে মামাতো বোন মোহনার সঙ্গে বাড়ির পাশে আমবাগানে আম কুড়াতে যায়। পরে তাদের লাশ পাওয়া যায় পাশের ওই ডোবায়। ধারণা করা হচ্ছে, ডোবায় পড়া আম কুড়াতে গিয়ে বা কুড়ানো আম পানি দিয়ে ধুতে গিয়ে একজন পিছলে গেলে অন্যজন তাকে তুলতে গিয়ে দুজনই হারিয়ে যায়।

মা–বাবা উভয়েই একটু সাবধান হলেই এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। বাপের বাড়িই হোক আর শ্বশুরবাড়ি হোক, দায়িত্বশীল বড় মানুষের তত্ত্বাবধান ছাড়া শিশুদের পানির কাছে, পুকুর-খাল-ডোবা বা নদীর তীরে পাঠানো যাবে না। গোসল তো নয়ই।

ডুবে যাওয়া শিশুর তুলনায় ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাওয়া শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি। বেঁচে যায় বলে তারা আর খবরে আসে না, আমরা হিসাব রাখি না। ডুবতে ডুবতে পানি খাওয়া শিশুর পেট থেকে পানি বের করার সনাতন পদ্ধতি শিশুর দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও বুদ্ধি বিকাশের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। যে দেশে এত শিশু প্রতিনিয়ত পানিতে ডোবার পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে, তাদের জন্য এখন পর্যন্ত কিন্তু কোনো সর্বসম্মত চিকিৎসা প্রটোকল তৈরি করা হয়নি। উপস্থিত চিকিৎসক নিজের উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে সংকট কাটানোর চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে এখনই আমাদের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

গওহার নঈম ওয়ারা
[email protected]