নুসরাত হত্যা: একটি 'দৃষ্টান্তমূলক' মামলার বিচার

নুসরাত জাহান
নুসরাত জাহান

বাংলাদেশে প্রতিদিন হত্যা, ধর্ষণসহ অনেক রকমের গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে; অধিকাংশ অপরাধের খবর সংবাদপত্র, টেলিভিশন, বেতার, অনলাইন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু সব হত্যা ও ধর্ষণের খবর একসঙ্গে অনেক মানুষকে নাড়া দিতে পারছে না। যেমন, মে মাসের প্রথম আট দিনেই সারা দেশে ৪১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, কিন্তু তার ফলে সমাজে তোলপাড় সৃষ্টি হয়নি, একসঙ্গে অনেক মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েনি।

মোটের ওপর এভাবেই চলছে বাংলাদেশ: প্রতিনিয়ত নানা গুরুতর অন্যায়-অপরাধ অবলীলায় ঘটে চলেছে, কিন্তু আমাদের কিছু এসে-যাচ্ছে না। কখনো কখনো মনে হয় আমাদের সংবেদনশীলতা বুঝি নষ্ট হয়ে গেছে, কিংবা এই জাতির গুরুতর স্নায়ুবৈকল্য ঘটেছে। নইলে তিন বছরের খুকি ধর্ষণের শিকার হলে কেন আমরা এই ভেবে স্তম্ভিত হই না: এ-ও কি সম্ভব! কেন আমরা প্রতিবাদে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ি না!

সম্ভবত এ দেশে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা এত গভীর হয়েছে যে শুধু নিজে ও নিজের পরিবারের বিপদমুক্ত থাকাই প্রত্যেক মানুষের প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে। অবশ্য এ ব্যাপারে দুশ্চিন্তায় ভোগা, যথাসম্ভব সতর্ক থাকা ও নিজের ভাগ্যের ওপর কিংবা সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রাখা ছাড়া বিশেষ কিছু করার নেই। কারণ, রাষ্ট্র ও সমাজের আইনশৃঙ্খলা ও মানুষের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত এবং নাগরিকদের করের টাকায় প্রতিপালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এমন আস্থা আর অবশিষ্ট নেই যে তারা আমার ও আমার নিকটজনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে: আমার শিশুকন্যাটিকে কিংবা তরুণী বোনটিকে ধর্ষণের শিকার হতে দেবে না, তরুণ ছেলেটিকে খুন হতে দেবে না।

না, বাংলাদেশে এ রকম ভরসা সম্ভবত কেউই করে না। বরং খুন-ধর্ষণ বা অন্য কোনো গুরুতর অপরাধের শিকার হলে আইন-আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে—এমন বিশ্বাসও ভীষণভাবে টলে গেছে। তাই প্রত্যেকের শেষ ভরসা সর্বশক্তিমানের ওপর, নিজের ভাগ্যের ওপর: আল্লাহর ওয়াস্তে আমার কিছু হবে না। ধর্ষণের শিকার হলে পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের মেয়েটি হতে পারে, খুন হলে অন্য কেউ; আমি নই, আমার ছেলেমেয়ে নয়। অলৌকিক সুরক্ষার ওপর এই গভীর আস্থাই সর্বাত্মক নিরাপত্তাহীনতার বোধে আক্রান্ত এই আত্মকেন্দ্রিক সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ‘ভাইটাল এনার্জি’ বা প্রাণশক্তির উৎস বলে আমার বিশ্বাস। তবে ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিকতাই চূড়ান্ত সত্য নয়, আমাদের এই অতিবিচ্ছিন্নতাপ্রবণ সমাজেও কখনো কখনো হঠাৎ আত্মকেন্দ্রিকতার ঘেরাটোপ অদ্ভুতভাবে টুটে যায়: কোনো কোনো ঘটনায় সমাজের সংবেদনহীনতা ও স্নায়ুবৈকল্য কেটে যায়, একসঙ্গে অনেক মানুষ একই আবেগে আলোড়িত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ রকম ঘটে অত্যন্ত পৈশাচিক, রোমহর্ষক কোনো ঘটনায়।

সাম্প্রতিক সময়ের এ রকম একটি ঘটনা ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের হত্যাকাণ্ড। হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে মেয়েটিকে। কারণ, সে নিজের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছিল, বিচার চাইতে থানায় মামলা দায়ের করেছিল তার পরিবার। শিক্ষকটি ওই মাদ্রাসার খোদ অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদদৌলা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতার সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী। এমনকি স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের ওপরেও তাঁর প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া গেছে। শ্লীলতাহানির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি নুসরাতকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাঁর লোকেরা সেই নির্দেশ অতি বিভীষিকাময় পন্থায় বাস্তবায়ন করেছে।

হাত-পা বেঁধে গায়ে আগুন ধরিয়ে না হোক, কত রকমের রোমহর্ষক কায়দায়ই না কত নারীকে ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও হত্যা করার খবর পাওয়া যায়। কাজ শেষে ঘরে ফেরার সময় তরুণীকে একলা পেয়ে বাসের ড্রাইভার-হেলপার উপর্যুপরি ধর্ষণ করে চলন্ত বাস থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে—এমন পৈশাচিক ঘটনার খবরও একাধিকবার প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু তাতে সমাজে এতটা তোলপাড় সৃষ্টি হয়নি, যতটা হয়েছে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায়। আমার ধারণা, এই তোলপাড় সৃষ্টির পেছনে রয়েছে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নাছোড় ভূমিকা। প্রথম আলোসহ মূলধারার সংবাদপত্রগুলো মুদ্রণ ও অনলাইন উভয় সংস্করণে একদম শুরু থেকেই ঘটনাটি সম্পর্কে খুঁটিনাটি খবরাখবর ফলোআপ করেছে, উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ, মন্তব্য প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি প্রকাশ করেছে। ফেসবুকেও ব্যাপক প্রতিবাদ, ক্ষোভ, হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিসংবলিত লেখালেখি প্রকাশিত হয়েছে। ভাইরাল হয়েছে নুসরাতের স্থিরচিত্র এবং সোনাগাজী থানার ওসির নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ধমকাধমকির ভিডিও চিত্র। নুসরাত হত্যার প্রতিবাদ ও হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে প্রবল জনমতের প্রতিফলন উভয় মাধ্যমেই ঘটেছে এবং জনমত প্রবলতর ও ব্যাপকতর করার ক্ষেত্রেও উভয় মাধ্যমই ভূমিকা রেখেছে।

নুসরাতের হত্যাকারীরা ও তাদের সহায়তাকারী, অভয়দানকারীরা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সেই কারণে অত্যন্ত প্রভাবশালী—এই বাস্তবতায় নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে জনমনে সংশয় কাজ করেছে। কারণ, এ দেশে এ রকম প্রভাবশালী লোকজনই গুরুতর নানা ফৌজদারি অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়; এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে ‘বিচারহীনতার পরিবেশ’। নুসরাতের হত্যাকারীরাও একইভাবে পার পেয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে সাংবাদিক, অধিকারকর্মী ও সচেতন নাগরিকদের একটা বড় অংশ এ রকম একটা দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে যে এদের কোনোভাবেই ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এ দেশের সংবাদমাধ্যমে সাধারণত কোনো আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনার ফলোআপ বেশি দিন ধরে চলে না; সপ্তাহখানেকের মধ্যেই অনেক ঘটনা অন্যান্য ঘটনার খবরের নিচে চাপা পড়ে যায়। কিন্তু নুসরাত হত্যার ক্ষেত্রে সে রকম ঘটেনি; সংবাদমাধ্যম শুরু থেকেই এটা নিয়ে লেগে থেকেছে এবং এখনো লেগেই আছে। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অবিরাম সক্রিয়তার ফলেই নুসরাত হত্যার বিচার ও অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে ব্যাপক জনমতের প্রচণ্ড চাপ সরকারের ওপর পড়েছে। সরকার আর দশটা ঘটনার মতো এটাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি; বরং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ রকম আশ্বাস উচ্চারণ করতে হয়েছে যে নুসরাতের হত্যাকারীরা যতই প্রভাবশালী হোক, পার পাবে না।

এসবের সুফলও দেখা যাচ্ছে: গত বুধবার পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (পিবিআই) নুসরাত হত্যা মামলার অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। মাত্র ১ মাস ১৯ দিনের মধ্যেই মামলাটির তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করা সম্ভব হয়েছে, বলা বাহুল্য, জনমতের চাপ ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের তাগিদের ফলেই। পিবিআইয়ের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, তাদের তদন্তে ১৬ আসামির বিরুদ্ধে নুসরাতকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা, হত্যার পরিকল্পনায় অংশ নেওয়া ও হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। আসামিদের তালিকার প্রথমেই আছে হত্যার নির্দেশদাতা অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার নাম, তারপরই আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সোনাগাজী উপজেলা শাখার নেতা রুহুল আমিনের নাম। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের নেতা হিসেবে রুহুল আমিনকে পিবিআই ছাড় দেয়নি। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের তো বটেই, পাহারায় নিয়োজিত ব্যক্তিদেরও আসামির তালিকায় রাখা হয়েছে। আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো নুসরাত হত্যা মামলার এজাহারে তার পরিবার আটজনকে আসামি করেছিল, আর পিবিআইএর তদন্তের পর আসামির সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে এবং পিবিআই ১৬ আসামির প্রত্যেকেরই সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছে।

সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ‘বিচারহীনতার পরিবেশে’ আইন প্রয়োগের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নুসরাত হত্যা মামলা এক ব্যতিক্রমী মামলা, যেখানে আইন প্রয়োগকারীরা আইনের যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক সক্রিয়তা দেখাল। এটা আপাতভাবে স্বস্তিদায়ক এই প্রত্যাশায় যে অন্তত নুসরাতের স্বজনেরা ন্যায়বিচার পেতে যাচ্ছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে দেখলে, সারা দেশে সংঘটিত অপরাধের তুলনায় ন্যায়বিচার পাওয়ার হতাশাব্যঞ্জক নিম্ন হারের কথা ভাবলে নুসরাত হত্যা মামলায় আইন প্রয়োগকারীদের ব্যতিক্রমী সক্রিয়তা উৎসাহব্যঞ্জক কিছু নয়।

কারণ হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি গুরুতর অপরাধের প্রতিটি ঘটনায় সমাজে, সংবাদমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একই রকমের তোলপাড় সৃষ্টি হয় না, হচ্ছে না, হবে না। অপরাধের স্বাভাবিক আইনি প্রতিকার নিশ্চিত করতে যদি পুরো সমাজকে ও সংবাদমাধ্যমকে এমন ব্যতিক্রমী মাত্রায় সোচ্চার হতে হয় যে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সাড়া পড়ে যায়, অন্যথায় যদি আইন প্রয়োগের স্বাভাবিক প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া কাজ না করে, তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আইনের শাসনভিত্তিক কোনো সমাজে অপরাধের স্বাভাবিক আইনি প্রতিকারের জন্য জনগণ, সরকার ও আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যতিক্রমী তৎপরতার প্রয়োজন হয় না।

জনমতের চাপেই শুধু অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি হবে, চাপ না থাকলে হবে না—এই পরিস্থিতি এককথায় নৈরাশ্যকর। এটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। আইন প্রয়োগকারীদের ব্যতিক্রমী ও দৃষ্টান্তমূলক সক্রিয়তাই স্বাভাবিক ও নিয়মিত প্রবণতায় পরিণত হোক। সেই সঙ্গে সমাজের সংবেদনশীলতাও বাড়ুক; যথার্থ কারণে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ক্লান্তি, শ্রান্তি, হতাশার অবকাশ নেই।

মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]