ব্রেক্সিট: ব্রিটেনের ব্যথা

এখনো মনে আছে সেই ভোরে সজীবের ফোন, ‘মা, এ তোমরা কী করলে?’ ঘুমের ধন্দে বুঝতেই পারছিলাম না আমি আবার কী করলাম? কখন করলাম, কাদের সঙ্গে নিয়ে করলাম?

সেটা ছিল ২০১৬ সালের ২৪ জুনের সকাল। বিলেতের প্রভাত, কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যদুপুর। ২৩ জুন ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোট হয়েছে। ভোট দিয়েছি, শেষরাত পর্যন্ত টিভিতে তার ফলাফল দেখে মোটামুটি একটা ভালো ধারণা নিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ‘না’ ভোটই জয়ী হবে। যতই ‘হ্যাঁ’–এর পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য ‘ইউকিপ’ দলের অভিবাসীবিরোধী নাইজেল ফারাজ, রক্ষণশীল দলের রাজনীতিকেরা, ক্ষমতালোভীবিরোধী দল সবাই মিলে বিলেতের গরিবের জন্য ইউরোপকে দায়ী করুন না কেন। এ তাদের যার যার বিশ্বাসের সিদ্ধান্ত। মানুষ কি তলিয়ে দেখবে না? বিশ্বাস মানেই তো যুক্তিহীনতা।

কিন্তু সজীবের বেদনার্ত বার্তায় জানতে পেরেছিলাম, আমার শেষরাতের ঘুমের অবসরে ফলাফল যা হওয়ার নয়, তা–ই হয়েছে। ‘মাগো এখন বেশ কয়েক’ বছর আর তোমার কাছে ফেরা হবে না। ব্রেক্সিট হলে বা হওয়ার আগেই দেখো ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক ও চাকরির অবস্থা কী হয়!

তখন আমার ছেলে ও মেয়ে দুজনই বাংলাদেশে চাকরি করে। ঈশিতা শিল্প-সংস্কৃতির আর সজীব অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। দুজনেরই নিজ নিজ ক্ষেত্র বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় উর্বর হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে দুবছরের চুক্তি শেষ করবার পর সজীবের বিলেতে ফেরার কথা।

তিন বছর পর দেখছি, ব্রেক্সিট নিয়ে ব্রিটেন সত্যি সত্যি গ্যাঁড়াকলে পড়েছে। সেদিন ছেলেটি যা যা বলেনি, এই তিন বছরে তা–ও হলো। এখন লন্ডনের পথে পথে ত্রিগুণ গৃহহীন ও ভাসমান মানুষ এবং এরা ভিন দেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুও না। এরা ককেশিয়ান এবং লন্ডনার। দ্রব্যমূল্যও এমন বেড়েছে যে আগে সুপার স্টোর থেকে কয়েকটা অগায়রা–মগায়রা মিলে বিশ পাউন্ডে যা কেনা যেত, এখন তা কিনতে লাগে ২২ বা ২৩ পাউন্ড। বাড়েনি বেতন কিন্তু চাকরিচ্যুতি হয়েছে হাজার হাজার। জিরো আওয়ার কন্ট্রাক্টে কাজ বেড়ে গেছে। অর্থাৎ ছাঁটাই হলে কোম্পানির কোনো দায় দায়িত্ব থাকছে না। কম মানসম্পন্ন ও কমদামি জিনিসে বাজার ভরে গেছে। ছোট ছোট পারিবারিক ব্যবসা আর নেই বললেই চলে। কর্নার শপ যা ছিল বিলেতের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি, তা উঠে গেছে। হলিডে ব্যবসা অর্ধেকে নেমে এসেছে, অন্ধকার হয়ে এসেছে ক্রিসমাসের আলোকমালা।

যেসব রাজনীতিক ইউরোপ ছাড়ার জন্য উল্লম্ফন করেছিলেন, তাঁরা এবং সাংসদেরা তো দফায় দফায় তেরেসা মের অনাস্থা প্রকাশ করে তাঁকে চেয়ারচ্যুত করে দিলেন। নিয়মানুযায়ী গত মার্চ মাসে ইইউয়ের সঙ্গে সব চুকেবুকে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঘষ্টাতে ঘষ্টাতে সে তারিখ অক্টোবরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে কোনো কল্যাণ হচ্ছে না দেশের। ব্যবসাপাতি সব আটকে আছে। ইউরোপের কেউ আসছেন না। অবস্থাদৃষ্টে মহাকবি কালিদাসের ‘কুমার-সম্ভবত’ কাব্যের পঞ্চম সর্গের একটি শ্লোকের শেষাংশ ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’র কথা মনে হলো—অর্থাৎ ত্রিশঙ্কু অবস্থা। ‘নো ডিল’ আর ‘ডিল’ উভয়ই জটিল হয়ে গেছে। খালি হাতে এই পরিবারবিচ্ছেদ থেকে মুক্তি চাইলেও গচ্চা দিতে হবে। গত তিন বছরে ব্রিটেন একেবারে ক্ষয়ে গেছে।

এর জন্য সদ্য পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দর-কষাকষির অনমনীয় ও শক্ত আচরণকেও দায়ী করছেন কেউ কেউ। পাঁচ শতাধিক স্কুল অভিযোগ এনেছে তিনি শিক্ষা খাতের বাজেট রিব্যালেন্স করার নামে কর্মচারী বরখাস্ত, ক্রস কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি বাতিল করে পাঠ্য বিষয় সীমিতকরণ থেকে একই ক্লাসে ঠেসে ঠেসে স্থানের অধিক ছাত্রছাত্রী ঢোকাতে বাধ্য করে তাদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। ইরাক আগ্রাসনের জন্য সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার যেমন ইরাকের বিরুদ্ধে একেবারে ডাহা বানোয়াট তথ্য দিয়েছিলেন, এবার ব্রেক্সিটের জন্য তা করেছেন কট্টর ব্রেক্সিট–সমর্থক পার্লামেন্ট সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনও। এই মিথ্যাচারের জন্য অতি সম্প্রতি ইউরোপিয়ান কোর্ট তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তাতে কী! সাধারণ মানুষের যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।

এদিকে আরেক কাণ্ড বেধে উঠেছে এ দেশে সরকারি আমন্ত্রণে আসা আমেরিকার অদূরদর্শী, বাচাল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পকে নিয়ে। প্লেন মাটি ছোঁয়ার আগেই তিনি টুইটারে চূড়ান্ত অবমাননামূলক মন্তব্য ছুড়ে দিলেন লন্ডন মেয়র সাদিক খানের প্রতি। আর নেমেই মাত্র হয়ে যাওয়া ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনে ‘ব্রেক্সিট পার্টি’ নামে নতুন দল বানিয়ে সবচেয়ে বেশি সমর্থন পাওয়া সাবেক ইউকিপ নেতা, চূড়ান্ত বর্ণবাদী ও ইউরোপবিদ্বেষী নাইজেল ফারাজ সম্পর্কে দুম করে বলে বসলেন, ইইউয়ের সঙ্গে দর-কষাকষি করার জন্য তাঁকেই পাঠানো উচিত। আরও বললেন, বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রীর জন্য যোগ্য ব্যক্তি। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাঁর কিছু বলা উচিত না হলেও তাঁকে থামায় কে? বলে মন্তব্য করেছেন। আর ইউরোপ হারিয়ে থেরেসা মে এখন আমেরিকার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়িয়ে তুলবার ও নতুন চুক্তি করবার জন্য মরিয়া। হায়, কোথায় ঘরের মানুষ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো আর কোথায় সেই আটলান্টিকের ওপারের অদ্ভুত দেশ আমেরিকা! এখন তাদের মুরগি খেয়ে সে দেশের মানুষের মতো অবিস হওয়া বাকি!

ব্রিটেনের দুরবস্থাকে একেক রাজনীতিক ধারা একেকভাবে পুঁজি করে নেমেছে। অনেকটা আমাদের দেশেরই মতো, এরা দেশের ভবিষ্যৎ নয় নিজেরা ক্ষমতায় যাবে কীভাবে—আর সাধারণ মানুষদের যা বোঝালে তা আয়ত্ত করা যাবে সেটাই তাদের কথা। কখনো ধর্ম, কখনো মিথ্যাচার আবার কখনো বৃহত্তর মানবতার দোহাই দিয়ে তাই চলছে। বিগত ৩০ বছর আমার দেখা ও অভিজ্ঞতায় ধারণা হয়েছে, গণতন্ত্রের কথা বললেও এ দেশের আসল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রকের বনেদি বিত্তবান ও এলিট ক্লাস। আর তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা বাস্তবায়ন করছেন তাদেরই বন্ধুবান্ধব ইটন শিক্ষিত রাজনীতিকেরা। দিনকে দিন তাই ধনীরা আরও বিত্তবান হয়েছেন। তাহলে শতকরা ৫১ ভাগ ‘হ্যাঁ’ ভোট দিল কি শুধু তারাই? না, কথায় আছে ‘ওল্ড ইমিগ্রান্ট হেইটস নিউ ইমিগ্রান্ট’। এরা সাধারণের মনে সেই ভয়ের পেছনে লাগিয়েছে ধোঁয়া। তাতে আগুন লেগে তাদের ঘর পুড়ে যাচ্ছে। ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়ে এখন তারা নিজেদের আঙুল কামড়াচ্ছেন।

যেকোনো জরিপ ফলাফল নিয়ে অ্যারিস্টটলের একটা কথা আছে, যা অনেকটা এ রকম, যখন পক্ষে–বিপক্ষে ব্যবধান হবে ন্যূনতম (ব্রেক্সিটে হ্যাঁ ৫১% না ৪৯ %), তখন তার ফলকে গণতান্ত্রিক বলে কাজে লাগানো ঠিক হবে না। কিন্তু সেটা তো হলোই না; উপরন্তু এই ফলাফলের কোনো বাধ্য বাধকতা না থাকলেও কেবল ক্ষমতায় থাকার জন্যই লাফিয়ে এসে থেরেসা মে এসে বললেন, ‘ব্রেক্সিট মিনস ব্রেক্সিট’। ব্যস, পেয়ে গেলেন প্রাচীনপন্থী বুড়োদের ও কুবেরদের সমর্থন। কিন্তু দিলেন পুরো ইউরোপকে খেপিয়ে। যে তরুণসমাজ ভোট দিতে যায় না, তারা বুঝল, এ তাদের ভবিষ্যতে ছুরি মারা হয়েছে। প্রতিবাদে প্রতিবাদে ওয়েস্ট মিনস্টার ছেয়ে গেল। তাতেই এই ঘষ্টাঘষ্টি আর দেরি। আর এখন দেখছি, একসময়ের রাজা ব্রিটেনের ভিখারি হওয়ার দশা।

আমি কবিতার কাজ শেষে সবে গ্রিস থেকে ফিরেছি। ব্রিটেনের সিদ্ধান্তে সে দেশে আগত অগণিত ইউরোপিয়ান ট্যুরিস্ট এবং গ্রিক জনগণ যে কী পরিমাণ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে আছে, তা পদে পদে অনুধাবন করে ফিরেছি।

গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে বিমানবন্দরে আমাকে যেদিক দিয়ে বেরোতে বলা হলো বেরোলাম। কিন্তু আমার আবাসিকত্ব দানকারী প্রতিষ্ঠানের কবি ও ডাইরেক্টর কারিন অ্যান্সিলিনকে তো আর পাই না। ফোন করলেই সে বলছে, আমিও তো এক্সিটের সামনেই দাঁড়িয়ে, কিন্তু তোমাকে তো দেখছি না। শেষে বুঝলাম, ব্রিটিশ পাসপোর্ট থাকলেও, ব্রিটেনের প্রতিনিধিত্ব করতে এলেও তারা আমাকে নন-ইউরোপিয়ান দরজা দিয়ে বের করে দিয়েছে! ওকে পাওয়ার পর বলে, সবে তো শুরু। তোমরা বুঝবে ঠেলা, পরিবারে থেকে তার মেম্বারদের সঙ্গে আড়ি দিলে কীভাবে থাকা হয়!

সে বুঝলাম আরও কজনের কথায়ও। অ্যাক্রোপ্লিসের চূড়ায় ক্লিওপেট্রা নামের এক অভিজ্ঞ টুইস্ট গাইড বলে বসলেন, ব্রিটেন আমাদের এই পার্থেনিন থেকে স্থাপত্য চুরি করেছে বলে তাদের হেইট করতাম। এখন আরও করি আমাদের মেলবন্ধন চুরমার করেছে বলে। আর ইংল্যান্ড থেকে বেড়াতে আসা স্টিফ মার্ফি আর তাঁর স্ত্রী আমিও ইংল্যান্ড থেকে গেছি শুনে প্রথমে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠেই এবার ফস করে নিভে গেলেন। বলা বাহুল্য, তারপর ডেভিড ক্যামেরুন, থেরেসা মে এবং এমনকি বিরোধী দলনেতা জেরেমি করবিনেরও নিকুচি করলেন। যে কদিন ছিলাম, অনুরূপ ঘটনা আরও ঘটেছে। এ নিয়ে মজার ঘটনা হয়েছে লন্ডনে ফিরে আসার দিন। আমার এশিয়ান ট্যাক্সিড্রাইভারও সেই একই প্রসঙ্গ নিয়ে এসে বলেন, যদিও আমিও ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছিলাম। কিন্তু এবার গণভোট হবে। এবার দেব ‘না’। আর আমরা এবার এক হয়ে যাব। আহারে আশা!

ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লৌহমানবী আশির দশকে তাঁর আমলে সুদূর আর্জেন্টিনায় ফকল্যান্ড যুদ্ধ বাধিয়ে আর্জেন্টিনাকে জন্মের মতো ব্রিটেনবিদ্বেষী বানিয়েছেন। আর রক্ষণশীল দলের আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ব্রেক্সিটের জন্য গণভোটের ব্যবস্থা করে ও পরে তাঁর স্থলাভিষিক্ত প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে ব্রেক্সিট নিয়ে ক্ষমতাসীন টোরিরা করলেন আমাদের বৃহত্তর গৃহচ্যুত। এখন আমেরিকার মুখাপেক্ষী হয়ে আমাদের হয়তো বাকি জীবন তাদের উচ্ছিষ্ট খেতে হবে, তাদের কারণে আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্য খাত বেহাত হয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসা হয়ে ছারখার হয়ে যাবে। বলেন, ঘরের মধ্যে ঝগড়া করে কোন বুদ্ধিমান?

লেখক: ব্রিটেনপ্রবাসী কবি ও কলামিস্ট