বাঁকের মুখে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: প্রথম আলো
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: প্রথম আলো

এগারোর বিধানসভা ভোটে বামপন্থীদের পরাজয়, দক্ষিণপন্থার উত্থানের পর রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নির্ণায়ক মুহূর্ত হয়ে থাকবে এবারের এই জাতীয় নির্বাচন।

তিন বছর আগে, বিধানসভা নির্বাচনে তিনটি ছাড়া রাজ্যের ২৯১টি কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজেপি জিতেছিল সাকল্যে তিনটি আসনে। ২৬৩টি আসনেই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। এবারে লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে বিধানসভাওয়ারি ফল ধরলে সেই বিজেপিই এগিয়ে ১২১টি আসনে। নিজের ওয়ার্ডে হেরে মুখ্যমন্ত্রী কোনোরকমে ‘লিড’ ধরে রাখতে পেরেছেন নিজের বিধানসভা ভবানীপুর কেন্দ্রে। বিজেপির সমর্থনের হার এক লাফে বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০ শতাংশ।

গত মাসের গোড়ায়, এখানেই লেখা শেষ নিবন্ধ শুরু করেছিলাম, ‘গুজরাটে দেখেছি, উত্তর প্রদেশে দেখেছি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে, এমন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আড়াই দশকের সাংবাদিকতার জীবনে কখনো দেখিনি।’ সত্যিই তা–ই। নিজের চেনা জায়গা নিজেরই কেমন অচেনা লাগে। পরিচিত মানুষকেও মনে হয় অপরিচিত। এমন তো ১০ বছর আগেও ছিল না। ভোট আসবে-যাবে। কিন্তু যে দেয়াল তুলে দেওয়া হচ্ছে, তাকে ভাঙবে কে! যত দিন বামপন্থীরা ছিল, তত দিন বিজেপি ছিল একেবারে প্রান্তিক শক্তি। মাথা তুলতে পারেনি উগ্র দক্ষিণপন্থীরা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী, বিধানসভায় ছিল না একজনও বিজেপির বিধায়ক। বামপন্থীদের সমর্থনের হার কমে এখন সাড়ে ৭ শতাংশ। বামপন্থীরা যত দুর্বল হয়েছে, তত মাথাচাড়া দিয়েছে উগ্র দক্ষিণপন্থীপন্থা। স্বাভাবিক। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

বিরোধীদের শূন্য করতে গিয়ে মমতা আজ নিজেই বিপর্যয়ের মুখে। ২০১১, পালাবদলের পরেই হাজার হাজার বামপন্থী পরিবার গ্রামছাড়া, ঘরছাড়া। ২১৩ জন বামপন্থী কর্মী-সমর্থক খুন। হাজারো বামপন্থী কর্মীর বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা। শয়ে শয়ে পার্টি অফিস, গণসংগঠনের অফিস বেদখল। বিরোধী স্বর, বিরোধী মত শুনলেই টুঁটি চেপে ধরে রক্তশূন্য করে দেওয়া। এক শ্বাসরোধী অবস্থা। ঠিক এক বছর আগে পঞ্চায়েত ভোটে ৩৪ শতাংশ আসনে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ দেখিয়ে একতরফা জয়। নির্বাচনে অবাধ লুট। রক্তাক্ত সন্ত্রাস। সংঘর্ষের বলি ৫৪ জন। রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বামপন্থাকে নিকেশ যজ্ঞের সেই অভিযান থেকেই আজ বিজেপির উত্থান।

ভুলে গেলে চলবে না এই পশ্চিমবঙ্গের রয়েছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ইতিহাস। ছেচল্লিশের দাঙ্গা। দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস। দেশভাগের সময় ও পরে দাঙ্গার ক্ষত। সুপ্ত সেই সাম্প্রদায়িক অনুভূতিকেই উসকে দিয়েছে মমতার রাজনীতি। প্রতিযোগিতার সাম্প্রদায়িকতা। আর এই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের আবহে পুরো ফায়দা তুলছে বিজেপি। সাতচল্লিশে স্বাধীনতা। দেশভাগ। বাংলা ভাগ। কোটি মানুষের জীবন–জীবিকায় কাঁটাতার। ভিটে হারানোর যন্ত্রণা। স্বদেশ, স্বজন হারানোর হাহাকার। ছিন্নমূল উদ্বাস্তু। ১৯০৫, উচ্চবর্ণের যে হিন্দুরা প্রথম বঙ্গভঙ্গ রুখে দিয়েছিলেন, ৪২ বছর পর দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গে কিন্তু তাঁরাই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা!

একান্নতে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বে জনসংঘের প্রতিষ্ঠা। জওহরলাল নেহরু বললেন, ‘আরএসএসের জারজ সন্তান’। বাহান্নতে নির্বাচন। হাজারে হাজারে মানুষ আসছে ওপার থেকে। এপার থেকেও যাচ্ছে অনেকে। সেই নির্বাচনে আজকের বিজেপির পূর্বসূরি জনসংঘ লোকসভায় এ রাজ্য থেকে পেয়েছিল সাকল্যে দুটি আসন। কলকাতা দক্ষিণ–পূর্ব কেন্দ্র থেকে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। মেদিনীপুর থেকে দুর্গাচরণ ব্যানার্জি। সমর্থনের হার ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। রাজ্য বিধানসভায় পায় ৯টি আসন। সমর্থনের হার ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অন্যদিকে, জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি পায় ২৮টি আসন। সমর্থনের হার ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। পাঁচ বছর পর সাতান্নর নির্বাচন। লোকসভায় এ রাজ্য থেকে জনসংঘ জিততে পারেনি একটি আসনেও। সমর্থনের হার নেমে আসে দেড় শতাংশে। বিধানসভাতেও শূন্য, সমর্থনের হার কমে ১ শতাংশের নিচে, শূন্য দশমিক ৯৮ শতাংশ। বিপরীতে কমিউনিস্ট পার্টির আসনসংখ্যা বেড়ে ৪৬। সমর্থনের হার বেড়ে ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। সেদিন এহেন সহায়ক পরিস্থিতি পেয়েও দাঁত ফোটাতে পারেনি সাম্প্রদায়িক শক্তি। ওপার বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তু হিন্দু পরিবার কিংবা রাজ্যের হিন্দুদের মধ্যে তৈরি করতে পারেনি সমর্থনের এতটুকু ভিত। কারণ, বামপন্থী প্রগতিশীল শক্তি সেদিন গ্রাম-শহরে চ্যাম্পিয়ন করতে পেরেছিল শ্রেণির ইস্যু।

দেশভাগের পরেই শহরে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন, ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলন, ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের জমির অধিকার, পুনর্বাসনের আন্দোলন, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন। আর গ্রামে জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, গরিবদের খাদ্যনিরাপত্তার আন্দোলন। এই আন্দোলনগুলোর যোগফলেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বামপন্থীদের পথচলা শুরু। বামপন্থীদের উত্থান। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিকল্প নীতির লড়াই। যার কেন্দ্রে ছিল শ্রেণির ইস্যু। যা পেছনে ঠেলে দেয় পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে, যা পরাধীন ভারতে অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে দীর্ঘদিন দাপট চালিয়ে এসেছিল। শ্রেণির ইস্যুতে এই শ্রেণি ঐক্যেই ২০১১ পর্যন্ত ঘটেনি কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা।

‘পঞ্চাশের দশকে প্রায় প্রতিবছরই কোনো না কোনো গণ-আন্দোলনের ডাক আমরা দিয়েছি এবং প্রতিটি আন্দোলনেই হাজার হাজার মানুষ কারাবরণ করেছে, লাখ লাখ মানুষ মিছিল ও সভায় অংশ নিয়েছে এবং বিভিন্ন দলমতের মানুষের সমর্থন আমরা পেয়েছি’, বলেছেন জ্যোতি বসু। প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের মাঝামাঝি সময়। ১৯৮১–এর সেপ্টেম্বরে। ‘গত তিন দশকের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা’ নিবন্ধে।

‘১৯৫২ সালের গণ–আন্দোলন ছিল দুর্ভিক্ষের অবস্থার বিরুদ্ধে। ১৯৫৩ সালের আন্দোলনের বিষয়বস্তু ছিল ব্রিটিশচালিত ট্রাম কোম্পানির ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে। ১৯৫৪ সালে শিক্ষকেরা প্রথম রাজভবনের সামনে রাস্তায় এসে বসলেন দাবি আদায়ের জন্য এবং অন্যান্য কর্মচারী মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন পেলেন। ১৯৫৬ সালের আন্দোলন ছিল বঙ্গ-বিহার সংযুক্তির সরকারি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। ১৯৫৮ সালে আবার খাদ্য আন্দোলন। ১৯৫৯ সালে খাদ্য আন্দোলনে ৮০ জন শহীদের কথা এখনো অনেকে ভোলেননি। ১৯৬০ সালে হলো সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘট। ১৯৬০-৬৫, চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ এবং পার্টির অভ্যন্তরে দ্বন্দ্বের জন্য তেমন বড় কোনো আন্দোলন সংগঠিত করা না গেলেও ১৯৬৬-তে খাদ্য ও বন্দীমুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। এই ব্যাপক গণ-আন্দোলনগুলোর মধ্যে হয়েছে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে অসংখ্য আংশিক সংগ্রাম। কারখানায়, অফিসে, গ্রামে, স্কুল-কলেজে।’

এবারে শোচনীয় পরাজয়ে বামপন্থীরা হারিয়েছেন অনেক কিছু। হারিয়েছেন সমর্থনের শক্ত জমি। কিন্তু সব শেষ হয়ে যায়নি। এখনো আছে অনেক কিছু। নির্বাচন হয়েছে বলে জ্বলন্ত ইস্যুগুলো হারিয়ে যায়নি। কৃষকেরা ভালো নেই। ফসলের দাম নেই, আত্মহত্যা করছেন। ছেলেমেয়েরা গাদাগাদা নম্বর পাচ্ছে, চাকরি পাচ্ছে না। সরকারি দপ্তরে নতুন নিয়োগ নেই, স্কুল-কলেজে নিয়োগ বন্ধ। বাড়ছে বেকারত্ব, নতুন শিল্প নেই। শুকিয়ে যাচ্ছে পুরোনো শিল্প। হুগলি নদীর দুই ধারে সারি সারি কারখানার কঙ্কাল। বন্ধ সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা। বেতন কমিশন ডিপ ফ্রিজে।

অন্ধকার সময়। সংকটের জঠরেই থাকে সম্ভাবনার বীজ। যেমন বলেছিলেন ডিকেন্স। ‘ইট ওয়াজ দ্য বেস্ট অব টাইমস, ইট ওয়াজ দ্য ওয়ার্স্ট অব টাইমস’—সেটা ছিল সর্বোত্তম সময়, সেটা ছিল নিকৃষ্ট সময়।


শান্তনু দে কলকাতার সাংবাদিক