'জাহাজ বাড়ি' ভেঙে ফেলা

যেকোনো জনপদের নাড়ির কথা তার ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের গায়ে লেখা থাকে। শতাব্দীপ্রাচীন ইট-কাঠের মলিন ও ক্ষয়িষ্ণু আস্তরণের ওপর কালের বিমূর্ত অক্ষরে লেখা গল্প বলে দেয়, কেমন ছিল এই জনপদের ঐতিহ্য? কী-ইবা ছিল তার সংস্কৃতি?

প্রাচীন স্থাপত্যে ইতিহাস-ইতিকথার বাস—যথার্থ শিক্ষার অভাবে এই কথা উপলব্ধির চেতনাগত সক্ষমতা সবার থাকে না। যাঁদের থাকে না তাঁরা
স্পষ্টতই সাংস্কৃতিকভাবে দীন-দরিদ্র। এই শ্রেণির লোকেরা যদি আর্থিকভাবে সম্পদশালী ও ক্ষমতাধর হন, তাহলে তার জন্য গোটা জাতিকে খেসারত দিতে হয়। সাংস্কৃতিকভাবে দরিদ্র এই ক্ষমতাধরদের কাছে স্থাপত্যগুলো নেহাতই অপ্রয়োজনীয় জঞ্জালপূর্ণ ‘ভূতের বাড়ি’। এগুলো নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সেখানে নতুন কোনো অর্থকরী ভবন বানানোকেই তাঁরা সঠিক বলে মনে করেন। এতে জাতির যে কত বড় ক্ষতি হচ্ছে, তা তাঁদের বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন মগজ ধরতে পারে না।

এ ধরনের সাংস্কৃতিক চেতনাবিবর্জিত ক্ষমতাধরদের সর্বশেষ বলি হয়েছে ঢাকার প্রথম বাণিজ্যিক ভবনখ্যাত শতবর্ষী ‘জাহাজ বাড়ি’। গত বুধবার
দিনভর ঈদ আনন্দ শেষে রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের বাসিন্দারা হঠাৎ ভাঙাভাঙির শব্দে সচকিত হন। তাঁদের চোখের সামনে ভেঙে ফেলা হয়
জাহাজ বাড়ি। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ইতিহাসের এই সাক্ষীকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার এই কাজটি করেছেন স্থানীয় সাংসদ হাজি সেলিমের লোকজন। ভবনের প্রায় সবটা ভেঙে ফেলার পর সেখানে পুলিশ গেছে এবং তাঁরা ভাঙাভাঙি ‘বন্ধ’ করেছে।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত সংগঠন আরবান স্টাডি গ্রুপের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, হাইকোর্ট ২০১৮ সালে পুরান ঢাকার ২ হাজার ২০০টি ঐতিহ্যবাহী ভবন ও স্থাপনার ধ্বংস, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন এবং সে তালিকায় জাহাজ বাড়িও আছে। তারপরও আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভবনটি ভাঙা হয়েছে।

এখন জানা যাচ্ছে, গত মার্চ থেকে জাহাজ বাড়ি ভাঙার চেষ্টা চলছিল। তখন জিডি করে থানার সাহায্যে ভাঙা বন্ধ করা হয়। এখন ঈদের ছুটিতে ভবনটি এমনভাবে ভাঙা হয়েছে, যাতে এ কাজে বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এ ভবনের যাঁরা ভাড়াটে ছিলেন তাঁরা বলছেন, এটি ওয়াক্ফ সম্পত্তি ছিল। তাঁরা ওয়াক্ফ প্রশাসকের প্রতিনিধিকে ভাড়া দিয়ে আসছিলেন। এ ধরনের সম্পত্তি কীভাবে কারা ভাঙল, তা অবশ্যই পরিষ্কার হওয়া উচিত। এ বিষয়ে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া না হলে অন্য প্রাচীন স্থাপনাগুলোও অরক্ষিত হয়ে পড়বে।

সবাইকে, বিশেষত সরকারের বোঝা দরকার এগুলো মামুলি স্থাপত্য নয়। এসব ঐতিহ্যের প্রাসাদ যদি ক্ষমতাধর মূর্খের গাঁইতির ঘায়ে ভেঙে পড়ে; সেগুলো যদি সরকারের অবহেলার আগাছায় ঢাকা পড়ে যায়, তাহলে জাতির জন্য সে বড় লজ্জার কথা।