বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো

পাকিস্তানি আমলের লজ্জাজনক এক উত্তরাধিকার হিসেবে মোট দেশজ উৎপাদনের অতি সামান্য অংশ কর হিসেবে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার ঐতিহ্য আমরা পেয়েছিলাম। তখন বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন কিংবা সেবাদানের ভিত্তিও ছিল সংকীর্ণ। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট উন্নতি ঘটলেও ওই অবস্থান থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি।

এরশাদের স্বৈরশাসনের একেবারে শেষের দিকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়লে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণদানের অন্যতম শর্ত হিসেবে প্রাচীন ও উন্নয়ন পরিপন্থী এক্সাইজ ডিউটির পরিবর্তে আধুনিক মূল্য সংযোজন কর (মূসক) প্রবর্তনে রাজি হয়ে রাজস্ব বোর্ড ওই নতুন আইনের একটি খসড়া দাঁড় করায়। এরই মধ্যে গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকারের পতন ঘটলে, বিশেষ অবস্থার কারণে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে মূল্য সংযোজন কর আইন–১৯৯১ কার্যকর করা হয়।

ওই আইন ও তার আওতায় প্রণীত বিধিমালা মূলত আগের মতোই থেকে যায় এবং পরবর্তীকালে ব্যবসায়ীদের চাপ ও কতিপয় কর্মকর্তার দুর্বলতার কারণে যে উদ্দেশে্য আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা থেকে ওই আইন একেবারে সরে যায়।

লক্ষ করা গেছে যে নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে, বিশেষত গত এক দশকে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণকারী হলেও ওই একই সময়ে কর ও জাতীয় আয়ের অনুপাত প্রায় অপরিবর্তিত থেকে, কখনো কখনো এই অনুপাতে নিম্নগামিতার ঝোঁক দেখিয়ে, আমাদের অর্থনীতির গতি–প্রকৃতির দিকে যাঁরা নজর রাখেন, তাঁদের ভ্রু কুঁচকানোর কারণ হয়েছে।

মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর-রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়ে একদিকে তা যেমন আমাদের উন্নয়নের প্রয়োজনে ক্রমাগত অধিকতর অর্থের জোগান দিতে পারে, অন্যদিকে আমাদের আঞ্চলিক ও সমশ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থানের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনীয় কর ও দেশজ উৎপাদনের অনুপাত যেন অর্জন করতে পারে, সে জন্যই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল মূল্য সংযোজন কর ও সাপ্লিমেন্টারি ডিউটিজ অ্যাক্ট–২০১২ প্রণয়নে বাংলাদেশকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বাংলাদেশের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল একটি দেশের ক্রমাগত অধিকতর রাজস্বের প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই কাজসহ অন্যান্য করব্যবস্থার সংস্কারের নেতৃত্ব আমাদের নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক শক্তির কাছ থেকে আসাটা প্রত্যাশিত ছিল।

গণমাধ্যম ও অন্যান্য উৎস থেকে যা এযাবৎ জানা গেছে, তাতে প্রায় স্থির নিশ্চিত যে ১৫ শতাংশ কিংবা অন্য কোনো সুনির্দিষ্ট হারের পরিবর্তে মূসকের হার হতে যাচ্ছে শূন্য শতাংশ, ২ শতাংশ, ৫ শতাংশ, ৭.৫ শতাংশ, ১০ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ—মোট ৬টি। আশা করা গিয়েছিল যে আইন পাসের সাতটি বছর পর অবশেষে রাজস্ব বোর্ডের বহু ঘোষিত ও প্রতিশ্রুত স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় কর আহরণ শুরু হবে। আশা ও আশঙ্কার কারণও এটি। কারণ, এতগুলো করহারকে কীভাবে রেয়াত দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে, নাগরিক সাধারণ তা বুঝতে পারছিল না। আর আশার কারণ এই যে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় কর ফাঁকির আশঙ্কা অনেক কমে যায়।

এখন মনে হচ্ছে, সব আশঙ্কার অবসান ঘটিয়ে শুধু ১৫ শতাংশ হারে কর প্রদানকারীরাই রেয়াত সুবিধা পাবেন, অন্য হারে প্রদানকারীরা তা পাবেন না এবং কোন ধরনের করদাতা কত শতাংশ হারে কর দেবেন, তা কোন ভিত্তিতে ঠিক করা হবে, সে-ও ছিল একটি অনিশ্চয়তার বিষয়। এখন সেই অনিশ্চয়তাও নাকি আর থাকবে না।

সরকারের দায়িত্বশীল মহল একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছে, এই করব্যবস্থা ধাপে ধাপে প্রবর্তিত হবে। সেটি একেবারে মন্দ নয়। একটু একটু করে করদাতারা শিখবেন। কিন্তু কী শিখবেন? অনুমান করা যাচ্ছে যে করদাতাদের কোনো রকমের যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য বর্তমানে যে শ্রেণির করদাতা যেমন হারে কর দিচ্ছেন, নতুন আইনেও সেভাবেই এবং সে হারেই কর দেবেন। অথচ সংশ্লিষ্ট মহলে বহুল আলোচিত কর্তিত করভিত্তি (ইংরেজিতে ট্রাঙ্কেটেড বেইজ) এবং ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে ১৫ শতাংশ হারে প্রদেয় কর আসলে ২ শতাংশ, ৫ শতাংশ কিংবা তার কিছু কমবেশি হতো। ওই দুটো নাম উঠিয়ে দিয়ে আগের হারেই এখন কর নেওয়া হবে। তাহলে আগেও তাদের যেমন রেয়াত ছিল না, এখনো তা থাকবে না।

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, এই যদি শেষ পর্যন্ত করা হবে, তাহলে উন্নয়নের জন্য রাজস্বের যে প্রয়োজন, তা আসবে কোত্থেকে এবং কীভাবে? আর নতুন এই আইন পুরোনোটির চেয়ে আলাদা কোন দিক থেকে?

দেশের উন্নয়ন যদি চাই এবং চাই যে তা নিয়ে কোনো প্রশ্নই হতে পারে না, তাহলে দেশ ও বিদেশ থেকে সরকারকে ক্রমাগত উচ্চ সুদে ধার করতে হবে। বিদেশের সঙ্গে লেনদেনের ভারসাম্য ইতিমধ্যেই বেশ চাপের মুখে। নতুন আইনের মাধ্যমে রাজস্ব আয়ে কোনো বিপ্লব যে ঘটবে, তা-ও মনে হয় না।

আমাদের মোট দেশজ উৎপাদন ও ঋণের অনুপাত এখনো ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু রাজস্ব আয় লক্ষণীয়ভাবে বাড়াতে না পারলে এই ভালো অবস্থান বেশি দিন ধরে রাখা যাবে বলে মনে হয় না। সেই দুর্দিন যেন আমাদের কখনো না আসে। কিন্তু আমাদের অদূরদর্শিতার ফলে তা যদি আসে, তাহলে নির্ঘাত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে যেতে হবে। তারা আবার শর্ত দেবে।

বাজেট নিয়ে অনেক কথা বলার থাকে। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় মূলত মূল্য সংযোজন কর আহরণ ও সে সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কিছু আলাপ করা গেল। উন্নয়নের যে মহাসড়কে আমরা পা রেখেছি, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে সেখান থেকে যেন আমরা ছিটকে না পড়ি, সেদিকে সবার, বিশেষ করে দেশচালকদের বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।

আলী আহমদ: এনবিআরের সাবেক সদস্য ও বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা