'মন্দের ভালো' চেতনায় অবৈধ ইটভাটার জোগান

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আমাদের মনোজগতে সবচেয়ে দাপুটে চেতনার নাম বোধ হয় ‘মন্দের ভালো’। তাই সব বিষয়েই ঘুরেফিরে শেষ বিন্দুটা দাঁড়ায় এই ‘মন্দের ভালো’। যেমন ঘুষ ব্যাপারটাই মন্দ। যেভাবেই দেখা হোক, ঘুষ নামক কর্মকে সাধুকাণ্ডের বর্ম বানাতে পারবেন না। তবে ‘মন্দের ভালো’ চিন্তা যখন সাধারণ মানুষের মনোজগৎ পেরিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানেও দাপুটে হয়ে ওঠে, তখন সেটা ভাবনার বিষয় বটে।

ঘুষ দিয়েছেন পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), সেটা নিয়েছেন দুদক পরিচালক। এই হলো অভিযোগের সমীকরণ। এর সমাধানসূত্র খুঁজতে গিয়ে দোষ কার বেশি, সেটা নিয়ে দুদক-পুলিশ দিনভর আলোচনা চলেছে।

অবৈধ ইটভাটা নিয়েও সেই একই হল্লা। অবৈধ হয়েও কেন এগুলো টিকে আছে? অবৈধ ইটভাটার চুল্লির চেয়ে ঘুষের তাপ বেশি বলে?

হাসন রাজা বলেছিলেন, ‘কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার’। আজকের দিনে কথাটা অন্য অর্থে সত্যি হয়ে উঠেছে। অবৈধ ইটভাটার সমারোহে যে হারে পরিবেশদূষণের মহড়া চলছে, তাতে দালানকোঠা বানাতে গিয়ে বাকি সব ‘শূন্যের মাঝার’ হতে চলেছে।

বায়ুদূষণে ঢাকাসহ প্রায় সব কটি শহরের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এই নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কবার্তা জানাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় জনস্বাস্থ্যের ওপর একের পর এক হুমকির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবু পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

গত ২৮ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। আদালতের নির্দেশ ছিল পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তারা যেন আদেশ পালন করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু গত ১৫ মে সিটি করপোরেশনের দাখিল করা প্রতিবেদনে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আদালত। ২৬ জুনের মধ্যে পুনরায় জমা দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে।

কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ কি নেওয়া হচ্ছে? পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, করণীয় ঠিক করে দেওয়া বা ব্যবস্থা গ্রহণে তাগাদা দেওয়ার কাজ তাদের। কিন্তু এসব করণীয় বাস্তবায়নে যেসব সরকারি সংস্থা কাজ করবে, তারা কাজ করছে না। যেমন: ভবনগুলো ধুলা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিচ্ছে কি না, তা দেখভাল করার দায়িত্ব রাজউকের। তারা যে ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তার প্রমাণও চলতে-ফিরতে পাওয়া যাচ্ছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঠেলাধাক্কা দিচ্ছে। এখানেও সেই ‘মন্দের ভালো’। কোন প্রতিষ্ঠান বেশি মন্দ, সেটা খুঁজতে গিয়ে আসল কাজই বন্ধ। এর মাঝখানে পড়ে জনসাধারণ ধুলার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে।

আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে, কোথায় ইটভাটা স্থাপন করা যাবে আর কোথায় যাবে না। যত্রতত্র ইটভাটার কারণে ফসলি জমি আর জনস্বাস্থ্য দুটোরই বারোটা বেজে চলেছে। বায়ুদূষণের অন্যতম কারণও নিয়মনীতি না মেনে ইটভাটা স্থাপন। পরিবেশের চিন্তাকে ইটভাটার চুল্লির মধ্যে ঢুকিয়ে অট্টালিকামত্ত উন্নয়ন দিয়ে বেশি দূর যাওয়া যাবে না। তার প্রমাণ, ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষিত নগরী হওয়ার ‘গৌরব’ অর্জন করেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে শুধু রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশের উৎস ইটভাটা, যা ক্রমাগত বাড়ছেই। এক হিসাবে দেখা যায়, ইট তৈরি খাত থেকে বছরে ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টন গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন হয়েছে ২০১৩ সালে। আইনের সারমর্ম হলো পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। কৃষিজমি, পাহাড় বা টিলা কেটে মাটি ব্যবহার যেমন করা যাবে না, তেমনি জ্বালানি কাঠও ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি ভিন্ন। বছরে ২২ লাখ টন কয়লা আর ১৯ লাখ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হচ্ছে ইট তৈরিতে। বিভিন্ন জায়গায় বন উজাড় করে গাছ কেটে ইটভাটার জ্বালানির জোগান দেওয়া হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটার বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলা ও ড্রাম চিমনি। একদিকে যেমন দেদার গাছ কাটা হচ্ছে, অন্যদিকে কৃষিজমি ও লোকালয়ের পাশেই হচ্ছে ইটভাটা স্থাপন।

আর অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসন বা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই ইটভাটা স্থাপন করা হচ্ছে। এসব কাজে ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার খবরও হরহামেশাই পাওয়া যায়। ২০ মে প্রথম আলোর খবরে দেখা যায়, বগুড়ার এক সাংসদ শপথ নেওয়ার দুই মাসের মধ্যেই ৩৪ লাখ টাকার গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ হলফনামার তথ্য অনুযায়ী তাঁর বার্ষিক আয় ছিল পাঁচ হাজার টাকা। শোনা যাচ্ছে, গাড়িটি তিনি ‘উপহার’ হিসেবে পেয়েছেন। আর তা দিয়েছেন অবৈধ ইটভাটার মালিকেরা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা একবার বলছিলেন যে ইটভাটা পরিদর্শনকালে নাকি অনেক সময় ইটের ঢিল খেয়েছেন। তাহলে এই আইনের আর কী মানে, যদি প্রয়োগের ব্যবস্থাই না থাকে? অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ইটভাটাসংক্রান্ত আইন হয়েছে এই দেশে।

আবার এই আইনও যে পরিবেশ রক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, এমন বলা যাবে না। মাটি দিয়ে ইট তৈরি করার বিধান থাকলে মাটির উপরিভাগ বা টপ সয়েল কেটে ব্যবহার করা হবেই। এ কারণে কৃষিজমির ক্ষতি হতেই থাকবে। মাটির ইটের বিকল্প অনেক উপকরণ উদ্ভাবন করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো ব্যবহারে নেই কোনো প্রচারণা বা পর্যাপ্ত প্রয়োগের ব্যবস্থা।

কিন্তু সবকিছুই নির্ভর করছে বিষয়গুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার ওপর। আর সেখানেই যত গলদ। এই গলদ কাটিয়ে উঠতে না পারলে আমাদের উন্নয়ন শুধু ভবন নির্মাণেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর পৃথিবী আর নির্মাণ করা হবে না। তবে সবেধন নীলমণি আমাদের সেই ‘মন্দের ভালো’ চেতনা। আগামী প্রজন্মের জন্য একটা ‘মন্দের ভালো’ পৃথিবী রেখে যাওয়ার আত্মপ্রসাদে ভুগতে ভুগতে তাদের ধুঁকতে থাকা দেখব—এটাই বোধ হয় একমাত্র সান্ত্বনা!

খলিলউল্লাহ্‌, প্রতিচিন্তার সহকারী সম্পাদক
[email protected]