ঋণের ফাঁদে বাজেট

বাজেটের পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, খাতভিত্তিক বরাদ্দ ও সমস্যা নির্ধারণ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হচ্ছে। অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ অত্যধিক। প্রতিবছরই বাজেটে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ঘাটতি মেটাতে ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। বাজেট বাস্তবায়নের হারেও দেখা যায় নিম্নমুখিতা।

চলমান আর্থিক বছরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কর আদায়ের পরিমাণ যেমন কম, তেমনি করের আওতাও বাড়েনি। গত বছরের জুনে ঘোষিত এ বছরের বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বিধায় সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। ঘোষিত ও সংশোধিত বাজেটের কর আদায়ের পরিমাণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান। ২০১৮-১৯ সালে কর থেকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। তার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর কর্তৃক মোট রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা সংশোধিত হয়ে ২ লাখ ৩ হাজার ৮৪৪ দশমিক ৭৮ কোটি টাকা হলেও এনবিআর জানাচ্ছে, এ বছরের মার্চ নাগাদ ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৯ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। অন্যদিকে একই অর্থবছরে এনবিআর–বহির্ভূত করের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। অতীত অভিজ্ঞতা বলে এ লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন সম্ভব হবে না।

মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ করদাতা। প্রতিবেশী দেশে অপেক্ষাকৃত কম হলেও করদাতার পরিমাণ ১৮ শতাংশের মতো। পরিসংখ্যান বলছে, সামর্থ্যবান মানুষের ৬৮ শতাংশই করের আওতায় নেই। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কর-জিডিপি হারও কম। জাতীয় আয়ের যে প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়, তার সঙ্গে সংগতিহীন। একদিকে কর আদায় ঠিকমতো হচ্ছে না, অন্যদিকে টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে। ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়ার প্রয়াস বিদ্যমান।

অন্যদিকে ব্যয় বেড়েই চলছে। ব্যয় দুই প্রকার—রাজস্ব ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাবদ ব্যয়। ঘোষিত বাজেট অনুযায়ী মোট ব্যয় ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। বিগত ১০ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাবদ ব্যয় ৫৫ শতাংশের কোঠায় থাকলেও মে ও জুন মাসে ব্যয়ের তথাকথিত উল্লম্ফন ঘটবে। রাজস্ব ব্যয় মোটামুটি ঘোষিত বাজেট অনুযায়ী হবে। অর্থাৎ ঘাটতি মোকাবিলায় ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাবে।

ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে সুদ-আসল পরিশোধ করতেই বিশাল ব্যয় হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে রাজস্ব ব্যয়ের ১৮ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশের গুণগত সার্বিক রূপান্তরে অত্যধিক প্রয়োজনীয় মানব পুঁজি বা দক্ষ শ্রমশক্তি বিনির্মাণে, তথা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। উপরন্তু ঋণের পরিমাণ সুদসহ জমতে জমতে পাহাড়সম হলে পরিশোধের কোনো দিকনির্দেশনাও বাজেটগুলোতে নেই।

বাজেট ঘাটতি মেনে নেওয়া যায়, যদি তা অর্থনীতিতে গুণক প্রভাব তৈরি করে। ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম বড় কারণ সরকারি চাকরিতে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পদ সৃষ্টি, গণহারে পদোন্নতির মাধ্যমে বেতনকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি। এ অর্থবছরে বেতন-ভাতার জন্য রাজস্ব ব্যয়ের ২০ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পত্রিকান্তরের হিসাব অনুযায়ী, উপসচিবের ৮৫০টি পদের বিপরীতে ১ হাজার ৫৫৪ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। যুগ্ম সচিবের ৪৫০টি পদের বিপরীতে ৭৮৭ জন, অতিরিক্ত সচিবের শতাধিক পদের বিপরীতে ৪৩৫ জন কর্মরত আছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। ২০১৭ সালে বিভিন্ন সংস্থায় ১৪২ জন কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে কর্মরতদের মধ্যে ১২ জন সচিবকে অবসরের পর পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দকৃত ব্যয় কতটা গুণসম্পন্ন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বারবার সংশোধনের ফলে ঋণের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে অস্বাভাবিক খরচও চোখে পড়ার মতো। পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়তে বাড়তে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। চার লেন সড়ক তৈরিতে যেখানে ভারতে ১১ থেকে ১৩ লাখ ও চীনে ১৩ থেকে ১৬ লাখ মার্কিন ডলার খরচ হয়, সেখানে বাংলাদেশে ৫০ লাখের বেশি। সম্প্রতি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে অনিয়মের খবর জনসমক্ষে এসেছে। বিভিন্ন প্রকল্পে কোন পর্যায়ের দুর্নীতি হচ্ছে, সহজেই অনুমেয়। এ ছাড়া অর্থবছর শেষে জোড়াতালি দিয়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ৯০-৯২ শতাংশ দেখানো হয়, যা প্রথম ১০ মাসের হিসাবের সঙ্গে কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ নয়।

দেখা যাচ্ছে, দেশের সাধারণ করদাতারাই ঋণ শোধ ও উন্নয়নের মূল উৎস হিসেবে কাজ করছেন। বারবার বলা হলেও আয়কর এখনো কর আদায়ের প্রধান উৎস নয়। মূল্য সংযোজন করের মাধ্যমেই ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে। এই আয়-নিরপেক্ষ পরোক্ষ করের বোঝা পুরোটাই সাধারণ জনগণের কাঁধে চেপে বসে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগণের ওপর করের ভার বর্তাচ্ছে। বিপরীত দিকে উচ্চবিত্তদের কর পরিহার ও ফাঁকি দেওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে!

২০০৯-১০ অর্থবছরের বাস্তবায়িত বাজেটে মূল্য সংযোজন করের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এ অর্থবছরের বাজেট পরিকল্পনায় ভ্যাটের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ বছরে ভ্যাটের হার প্রায় ৩৮০ শতাংশ বেড়েছে! ভ্যাট সরকারের কাছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস! এ প্রক্রিয়ায় করব্যবস্থা আরও ব্যাপকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল (রিগ্রেসিভ) হয়েছে।

আবার সাধারণ জনগণকে বড় ঋণখেলাপিদের জন্যও প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে। গত কয়েক বছরে সরকারি ব্যাংকের মূলধন সংকট মেটাতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি কর থেকে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ জনগণ করের বোঝা বহন করে চললেও এর বিনিময়ে জনসেবা পাওয়ার চিত্র হতাশাজনক। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গুণগত উন্নয়ন প্রশ্নের সম্মুখীন। এ ছাড়া নিরাপদ সুপেয় পানি, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সুবিধাসহ অন্যান্য জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড মন্থর গতিতে এগোচ্ছে।

বাজেটে মৌলিক সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে না। জিডিপিতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২৩ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে। নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রার্থীর জন্য চাকরির বাজার অপর্যাপ্ত। আবার চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষার মান সমানতালে বেড়ে উঠছে না। বিদেশ থেকে দক্ষতার ঘাটতি পূরণে জনবল আমদানি করতে হচ্ছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারত প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। বর্তমানে ৪ কোটি ৮২ লাখের মতো তরুণ বেকার। ৪৭ শতাংশ স্নাতক বেকার। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমজরিপ মতে, ১৪ লাখ মানুষ স্থানীয় শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে, বিপরীতে ১৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা ও প্রার্থীদের দক্ষতার অভাব নিয়েও বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

অসমতা বাড়ছে হু হু করে। ২০১৬ সালে বৈষম্য পরিমাপকারী জিনি সূচক শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালে শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ ছিল। ২০১৬ সালে সবচেয়ে দরিদ্র ১০ শতাংশ মানুষের আয়ের অংশীদারত্ব ২০১০ সালের তুলনায় কমে ১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ হয়েছে। ২০১০ সালে ২ শতাংশ ছিল। ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রতিবছর দারিদ্র্য কমার হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে এ হার কমে ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। দারিদ্র্য কমার হার কমছে, দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১৪৫টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলমান থাকলেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত লোকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এ খাতে আর্থিক বরাদ্দ নেপাল ও ভুটান থেকেও কম।

উৎপাদনশীল খাতের পরিমাণ বাড়ছে না ও বহুমুখীকরণ হচ্ছে না। এক খাতকেন্দ্রিক নির্ভরতা অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরে নতুন কোনো নির্ভরযোগ্য উৎপাদনশীল খাত তৈরি হচ্ছে না। গত ছয় বছরে শিল্পকারখানার সংখ্যাও বাড়েনি, কমেছে ৬০৮টি। ২০১২ সালে বড় শিল্পকারখানা ছিল ৩ হাজার ৬৩৯টি, ২০১৯ সালে সংখ্যা কমে ৩ হাজার ৩১টি হয়েছে। মাঝারি শিল্পকারখানা ৬ হাজার ১০৩টি থেকে কমে ৩ হাজার ১৪টি হয়েছে। ক্ষুদ্র শিল্পকারখানার সংখ্যাও কমেছে। শিল্প খাতে বর্তমানে ১ লাখ ২৯ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ২০-২২ লাখ চাকরিপ্রার্থী তরুণ-তরুণীর তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। মৌলিক সমস্যাগুলোর এরূপ প্রকটতার মুখ্য কারণ হলো প্রতিষ্ঠানগুলোর ভঙ্গুরতা, বিনিয়োগে আস্থাহীনতা ও পুঁজি পাচার।

বাংলাদেশের বাজেট–ব্যবস্থায় জবাবদিহির চর্চা নেই। বাজেট ঘোষিত হওয়ার পর আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংশোধিত হয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী সংশোধিত বাজেট সংসদে উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় আলোচনা ছাড়াই আইনে পরিণত হয়। কেন সংশোধনের প্রয়োজন হলো বা কেনই–বা বাস্তবায়িত হলো না, কোনো তর্কাতর্কি হয় না। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, কণ্ঠভোটে বাজেট পাস করা ছাড়া সাংসদদের কোনো প্রকৃত ক্ষমতাও নেই। বাজেট–ব্যবস্থার আমূল সংস্কার আশু প্রয়োজনীয়।


ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন