প্রস্তাবিত বাজেটে কালোটাকা

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখায় সমাজে কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, কালোটাকা ব্যবহারের সুযোগপ্রাপ্ত খাতে দুর্নীতির একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, সৎ পথে এসব খাতে আয় ও সম্পদ আহরণের সুযোগ ধূলিসাৎ হবে; এর প্রভাবে দুর্নীতির বিস্তৃতি ও গভীরতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

আমরা অর্থ উপার্জনের সব অবৈধ পন্থার বিরোধী এবং অবৈধ পন্থায় প্রাপ্ত বা গৃহীত অর্থ বৈধ করার সুযোগ না রাখার পক্ষপাতী। আমাদের এই অবস্থান প্রথমত নৈতিকতাপ্রসূত, দ্বিতীয়ত সাংবিধানিক নির্দেশনার সঙ্গে একাত্মতাপূর্ণ। সংবিধানের ২০ (২) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ করা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না।’ এই আলোকে বলা যেতে পারে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ সংবিধানের পরিপন্থী। এটা কোনো বিবেচনাতেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।

তবে কালোটাকা বলতে যে অপ্রদর্শিত আয় বোঝানো হয়, তার কিছু অংশ বৈধ পন্থায় উপার্জিত হতে পারে, যার বিপরীতে কর প্রদান করা হয়নি। এই ধরনের অর্থ কর প্রদানের মাধ্যমে বৈধ করার সুযোগ রাখা যেতে পারে। তবে কর প্রদান না করা বা আয় অপ্রদর্শিত রাখার প্রবণতাকে সর্বতোভাবে নিরুৎসাহিত করা উচিত; এর একটি পদক্ষেপ হিসেবে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের মাধ্যমে বৈধ করার সময় জরিমানা হিসেবে বর্ধিত মাত্রায় করারোপ করা যেতে পারে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখার একটি উদ্দেশ্য, টাকা পাচার বন্ধ করা। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যেতে পারে, এভাবে টাকা পাচার বন্ধ করা সম্ভব হবে না। অতীতে সব সরকারই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও অধিকাংশ সময়েই তা করেছে।কিন্তু তার ফলে টাকা পাচার বন্ধ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) হিসাব অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে।

সুতরাং টাকা পাচার রোধ করার লক্ষ্যে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার ভাবনাটি যে ফলপ্রসূ হয়নি, তা স্পষ্ট। আরও যে কারণে এটা সমর্থনযোগ্য নয় তা হলো, এতে বৈধ পন্থায় উপার্জনকারী ও যথাসময়ে কর প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের বৈষম্যের শিকার বলে অনুভব করতে পারেন, তাঁরা হতাশ হতে পারেন। এটা কর প্রদানে উৎসাহ বৃদ্ধির বিপরীত ফল বয়ে আনতে পারে। কালোটাকার মালিকদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে মাত্র ১০ শতাংশ কর পরিশোধের মাধ্যমে বিনিয়োগ করার সুযোগের প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ বৈধ পন্থায় উপার্জনকারী ও নিয়মিত কর প্রদানকারীদের জন্য কোনো কোনো খাতে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর প্রদান করতে হয়। এই বৈষম্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সৎ পন্থাকে উৎসাহিত করা এবং কর প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে তোলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা উচিত। রাষ্ট্রের দায়িত্ব অসৎ ও অবৈধ পন্থায় অর্থ সংগ্রহকারী ও কর ফাঁকি দানকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে এই প্রবণতা নিরুৎসাহিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন; কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণারও পরিপন্থী। কারণ, এই সুযোগ দেওয়া হলে দুর্নীতিবাজেরা আরও উৎসাহিত হবেন। আমরা চাই, প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট অনুমোদনের আগে কালোটাকা সাদা করার সুযোগের বিষয়টি বাদ দেওয়া হবে।