বাজেটের স্বাধীনতায় বিচারের স্বাধীনতা

গত মাসে শুনলাম, ঝিনাইদহে এক বিচারক এজলাসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। মুঠোফোনে তাঁর চিকিৎসকের কাছ থেকে শুনেছিলাম, কিছুটা হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। প্রশাসন ক্যাডারের অপেক্ষাকৃত কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের কক্ষ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। অথচ জেলা জজদের বিচার কক্ষগুলো প্রচণ্ড দাবদাহে ধুঁকছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারকদের মর্যাদাবিষয়ক মামলা বিচারাধীন। অন্যদিকে জ্যেষ্ঠ জেলা জজরা চোখের সামনে দেখেন, কী হতে কী হলো। পুরোনো রাষ্ট্রাচারে জেলা জজরা উপসচিবদের সমমর্যাদার। উপসচিবেরা গাড়ি কেনার সুদমুক্ত ঋণ ও রক্ষণাবেক্ষণে মোটা অঙ্কের ভাতা পান, কিন্তু জেলা জজরা এসবের কিছুই পান না। উপসচিবেরা ঠান্ডা ঘরে অফিস করেন।

জেলা জজরা গরমে মরেন। মোবাইল কোর্ট অসাংবিধানিক, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা তা চালিয়ে ভাতা পান। হালনাগাদ স্কেলে বিচারকদের ৩০ ভাগ বিশেষ ভাতার বিধান মানেনি প্রশাসন ক্যাডার। তাই ২০০৯ সালের পুরোনো স্কেলে ভাতা পাওয়া সব বিচারকের ললাটলিখন।

এ রকম পরিস্থিতিতে শতকরা হিসাবে বিচার বিভাগের বাজেট কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা গত এক দশকের মধ্যে এখন সর্বনিম্নে। ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেটে বিচার বিভাগের জন্য ১ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। শতাংশের হিসাবে এটা দশমিক ৩৫ [ লেখচিত্র দেখুন]।

বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩০ লাখ থেকে বেড়ে ইতিমধ্যে ৪০ লাখ, বছর ঘুরতে ৫০ লাখ হবে। এ অবস্থায় সুপ্রিম কোর্ট ও নিম্ন আদালত মিলে বিচার বিভাগের জন্য সাকল্যে মাত্র ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাজেটের চেয়ে ১ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা কম।

বিচারকসহ বিচার বিভাগের লোকবল ও সব ধরনের লজিস্টিকস সহায়তা বাড়ানো জরুরি। কিন্তু নতুন বাজেট মুদ্রাস্ফীতিরও সমন্বয় করেনি। বিচারক ও আদালত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত লোকবলের স্বল্পতা নতুন বাজেট দূর করতে পারবে না। বিচারব্যবস্থার দুর্বল অবকাঠামো, বিচারপতি ও বিচারকদের জন্য আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা দিতে না পারা এবং বিশেষ করে সুযোগ-সুবিধা লাভে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের তুলনায় বিচারকদের যথেষ্ট পিছিয়ে থাকার বিষয়টি নতুন করে সামনে এল। আমাদের বিচারকেরা নানাভাবে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। সেই ধারা নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটেও অব্যাহত আছে। তবে এই লেখায় আমরা দেখব বাজেটের সঙ্গে বিচারের স্বাধীনতার কী সম্পর্ক।

১৯৮১ সালে আন্তমহাদেশীয় প্রধান বিচারপতিদের সম্মেলনে গৃহীত ‘সিরাকাস নীতি’র ২৪ ও ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘টাকার অঙ্কেই যেন প্রতিবিম্বিত হয় বিচারিক কার্যক্রমের স্বাধীনতা। বাড়তি কাজের চাপ ছাড়াই আদালত চলবে পর্যাপ্ত টাকায়। বিচার বিভাগ নিজেই নিজের বাজেট প্রাক্কলন করবে।’ বাহাত্তরের সংবিধানের খণ্ডিত ব্যাখ্যার কারণে একটি সত্য পাথরচাপা আছে। সেটা হলো হাইকোর্টই বাজেট করবে, হাইকোর্টই তা খরচ করবে। ১০৯ অনুচ্ছেদের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাখ্যা আমাদের কাছে তাই। তাই হাইকোর্টকে এড়িয়ে আইন মন্ত্রণালয় যেভাবে অধস্তন আদালতের বাজেট তৈরি ও বাস্তবায়ন করে চলছে, সেটা অসাংবিধানিক।

১৯৮২ সালে ইসরায়েলের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিম সিতরিত, যিনি ‘বাজেটের স্বাধীনতায় বিচারের স্বাধীনতার’ ধারণা প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়াজুড়ে নন্দিত, তাঁর সুপারিশে ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন ‘দিল্লি ঘোষণাপত্রে’ বলে, বিচার প্রশাসন পর্যাপ্ত টাকাকড়িতে যৌথভাবে আদালত ও নির্বাহী অঙ্গ দ্বারা চলবে। আবার ১৯৮৩ সালে মন্ট্রিয়লের বিশ্ব বিচারপতি সম্মিলনে সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘আদালতই প্রধানত বিচার প্রশাসন চালাবে। পর্যাপ্ত সম্পদের জোগান দেওয়া হবে রাষ্ট্রের ‘প্রায়োরিটি অব দ্য হাইয়েস্ট অর্ডার’। কিন্তু বাংলাদেশে শিথিলভাবে সুপ্রিম কোর্ট কার্যকর, আর অধস্তন আদালতের বাজেট প্রশ্নে হাইকোর্ট সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এ বিষয়ে হাইকোর্টও অমনোযোগী।

১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের সপ্তম মিলান কংগ্রেস প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রকে আদালত চালাতে ‘পর্যাপ্ত তহবিল’ দিতে অঙ্গীকার করিয়েছিল। ১৯৮৬ সালে বিচারপতি ও আইনজীবীদের লুসাকা সেমিনার যথার্থ রোগ শনাক্ত করেছিল। লুসাকাপত্র বলল, বিচারিক কর্মকর্তা ও তাঁদের সহকারীর সংখ্যা হতে হবে পর্যাপ্ত। বিচার প্রশাসনের সবটুকুর ওপর কর্তৃত্ব থাকবে প্রধান বিচারপতির। আর বিচার বিভাগের বাজেটে বড় গলাটা বিচারালয়েরই থাকতে হবে। ১৯৮৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট ভেনেজুয়েলা সম্মেলনে ইউনেসকোর কাছে মামলার অনুপাতে পর্যাপ্ত বেতন-ভাতাসহ সহকারী যুক্ত করে বিচারক সংখ্যা নিয়োগের ধারণা গ্রহণে সুপারিশ করেছিল। পরে ভারতীয় আইনবিদ ড. এল এম সিংভি এর ভিত্তিতেই তাঁর চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি জাতিসংঘের ৪৫ তম অধিবেশনে পেশ করেন। এতে বলা হয়, বিচার প্রশাসনের চাহিদামতো বাজেটে বরাদ্দ দেওয়াই হবে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে প্রধান বিচারপতিদের ষষ্ঠ সম্মেলনে ওই সব নীতিমালার সঙ্গে ১৯৮৫ সালের টোকিও নীতি ও ১৯৯৩ সালে প্রধান বিচারপতি সম্মেলনে গৃহীত কলম্বো নীতি এবং সর্বোপরি জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র যুক্ত হলো। অন্য নীতিগুলোর মতো বেইজিং ঘোষণাপত্রটি মানতেও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা আছে। বেইজিং ঘোষণাপত্র বলল, সমাজ মুক্তির জন্য চাই স্বাধীন বিচার বিভাগ। এই স্বাধীনতার মানে হলো আদালতই বাজেট করবেন, আদালতই তাঁর প্রশাসন চালাবেন। আদালতকে সম্পদের জোগান দিতে কার্পণ্য করা তো যাবেই না, বরং সব থেকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। অপ্রিয় হলেও সত্য, বাংলাদেশ উল্লিখিত আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত ও ঘোষণাপত্রগুলো নাকচ করে চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাজ্যে অধস্তন আদালত প্রশাসনের তৈরি করা বাজেটই প্রধান বিচারপতির অনুমোদনে সরাসরি আইনসভার কাছে যায়।

আবার একাধিক অঙ্গরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট ইমারত পর্যন্ত গড়ে নিজ তদারকিতেই। ১৯৮০ সালে ১০ ভাগের বেশি হারে বিচারকদের বেতন ফেডারেল সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে বেড়েছিল। ১৯৮৯ সালে মার্কিন কংগ্রেস একটি ব্যতিক্রমী আইন করে দুই বছরে বিচারকদের বেতন ৩৩ ভাগ বাড়িয়েছিল। অনেক বাধার মধ্যে বর্তমান সরকারও বিচারকদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। তবে তার সবটুকু বাস্তবায়ন বা তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি।

ইংল্যান্ডেও একটা দীর্ঘ সময় সরকারের বাজেট নিয়ন্ত্রণকে বিচারকের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছে। ১৯৬৫ ও ১৯৯২ সালে আইন করে হাইকোর্টের বিচারকদের বেতন যথাক্রমে ২৫ ও ১৯ ভাগ বাড়ানো হয়েছিল। এরপরও লম্বা সময় জ্যেষ্ঠ সচিব ও হাইকোর্ট বিচারকদের বেতনের সমতা ছিল। ১৯৭৪ সালের আগে উচ্চপর্যায়ের কমিটি এমন অগ্রহণযোগ্য সমতায় কোনো অসুবিধা দেখেনি। এ মুহূর্তে ইংল্যান্ডের হাইকোর্টের বিচারকদের বার্ষিক বেতন ১ লাখ ৮৫ হাজার পাউন্ড, আর সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্টদের বার্ষিক বেতন ১ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। বিচারকেরা সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্টদের চেয়ে বেশি বেতন পেয়েও কাজের চাপের তুলনায় এ বেতনে অসন্তুষ্ট। ব্রিটেনে বিচারক পদে বিরাট শূন্যতা চলছে। বারের বেশি উপার্জনকারী মেধাবীরা মুখ ঘুরিয়ে আছেন। কোথাও ৪০ ভাগের মতো খালি। মেধাবীদের বেঞ্চে ভেড়াতে আর কর্মরতদের চাঙা করতে এ মাস থেকেই হাইকোর্টের বিচারকদের মূল বেতনের ১৩ শতাংশ এবং ক্রাউন কোর্ট ও আপার ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের জন্য ১৫ ভাগ ভাতা বাড়ছে। ব্রিটেনের আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিচারকেরা আমাদের গণতান্ত্রিক সমাজের খুঁটি। তাঁদের অভিজ্ঞতা ব্রিটেনে শত শত কোটি পাউন্ডের ব্যবসা ডেকে আনে। আর তাঁদের ছাড়া জনগণ বিচার পেতে পারে না।’ আমাদের সিভিল সার্ভেন্টরা যদি কখনো দেখেন যে বিচারকের বেতন ১৩ ভাগ আর একই সময়ে তাঁদেরটা ৩ ভাগের কম বেড়েছে, তাহলে তাঁরা কী করতে পারেন, আমরা তা অনুমান করতে পারি। অবশ্য ইংল্যান্ড এটাও হজম করছে যে কিছু শীর্ষ আমলার বেতন প্রধানমন্ত্রীর থেকে বেশি।

এবারের বাজেটে সংশোধনী এনে অন্তত ২ হাজার বিচারক নিয়োগের সংস্থান এবং যাঁরা আছেন তাঁদের সব ধরনের সুবিধা অন্তত উপমহাদেশীয় পর্যায়ে আনা হোক। মোদি সরকার উচ্চ আদালতের পে-কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী বিচারকদের বেতন সম্প্রতি প্রায় ২০০ ভাগ বাড়িয়েছে। আর নিয়ম করেছে ১০ বছর অন্তর এটা বদলাবে। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের পে-কমিশন অকার্যকর হয়ে গেছে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]