বাজেটে কৃষিস্বার্থ

ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কৃষক ক্ষোভে–দুঃখে ধানখেতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন, এমন ঘটনার মধ্যে নতুন বাজেট এসেছে। আশা করা হয়েছিল কৃষকের উদ্বেগ প্রশমনে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় উপযুক্ত কোনো রক্ষাকবচ নেওয়া এবং দেশের বিরাজমান কৃষি ও খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা বিস্তারিত ব্যাখ্যা থাকবে। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় এসব না থাকা হতাশাব্যঞ্জক। আমরা স্মরণ করতে পারি, সারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে কৃষককে অতীতে নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছিল। কিন্তু সমকালীন অর্থনীতিতে সাধারণের ব্যবস্থাপনাগত বিপর্যয় দেখিনি। কৃষিজীবনচক্রে যথাযথ রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বহুমাত্রিক সুফল জনগণ পেয়েছে। কিন্তু এখন সংকট দেখা দিয়েছে কৃষকের স্বার্থরক্ষা। কৃষক কী করে তাঁর উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন, সেটা নিশ্চিত করা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এসব দিকে রাষ্ট্রীয় নীতির বিরাট ঘাটতি চলছে।

নতুন বাজেটে কৃষকের জন্য অবশ্য শস্যবিমা চালু এবং কৃষি উপকরণ সরবরাহের বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাদি অব্যাহত রাখার আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তা বাংলার কৃষক সমাজকে সংগত কারণেই আশ্বস্ত করতে পারেনি। শস্যবিমা কীভাবে কৃষক স্বার্থ রক্ষা করবে, সেটা পরিষ্কার নয়। শস্যবিমা সাধারণত আবহাওয়া ও দুর্যোগের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু দেশের কৃষকের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো ফসলের উৎপাদন খরচ কমানো এবং তার ন্যায্যমূল্য পাওয়া। কৃষকের জীবন এখন পর্যন্ত ঋণের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত নয়। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষক কুঞ্জমোহন আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর মৃত্যুর কারণ নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের যেটা বিবেচনায় নিতে হবে, সেটা হলো বিভিন্ন এনজিও ও সমবায় সমিতি থেকে তিনি ঋণ নিয়েছিলেন। ধানের দাম না পাওয়ায় তাঁর ঋণ শোধের সামর্থ্য ছিল না।

সরকার মনে করতে পারে সার, কীটনাশক, সেচ-সুবিধাদির জোগান সরকার ভালোভাবেই দিচ্ছে, তাই কৃষকের ওপর আগের মতো আর খরচের চাপ পড়ে না। আর পণ্যের দাম তো মুক্তবাজার-ব্যবস্থাই নিয়ন্ত্রণ করবে। আমরা মনে করি, এ ধারণার ভুলগুলো চিহ্নিত এবং তা নির্মোহভাবে খতিয়ে দেখার এখনই সময়। কৃষককে অনবরত চাপে রাখলে তাঁর পক্ষে পেশায় নিজেদের ধরে রাখা কঠিন হবে। এর পরিণতিতে কৃষিক্ষেত্রে দক্ষতার ঘাটতি এবং কৃষকের পেশাবদল অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের সংকটকে তীব্রতা দিতে পারে। এর ফলে কৃষির সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা দুরূহ হবে।

কৃষি উপকরণ সরবরাহের সুফলের অভিঘাত নিশ্চয় প্রান্তিক কৃষক ও জমির মালিকের ওপর একইভাবে পড়ে না। সরকারি নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই জমির মালিক, মধ্যস্বত্বভোগী এবং কৃষকের স্বার্থকে পৃথক করতে হবে। কৃষক যে ফসলের ভাগটা পান, তাঁকে সেটা অনেক সময় জমিতেই বিক্রি করার তাড়া থাকে। অথচ ধনী কৃষক তাঁর ফসল কিছুদিন ধরে রাখতে পারলেই সেটা ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, জমির উর্বরতা শক্তি কমছে, পানি, সার ও কীটনাশক আগে যা লাগত, তার চেয়ে পরিমাণে এখন বেশি লাগছে। আবার সব উপকরণের দামই বাড়ছে। সুতরাং কৃষিতে রাষ্ট্র তার হস্তক্ষেপ ১০ বছর আগে যা করছিল, সেখানে আজ বড় ধরনের সমন্বয় আনাটা অপরিহার্য।

কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কিনে ভোক্তার কাছে বাজার স্থিতিশীল রাখার বিকল্প আমরা এখনো দেখি না। তাই খাদ্যগুদাম বাড়াতে হবে। এ জন্য আমরা বাজেটে দরকারি সংশোধনী চাই। কৃষকের কাছ থেকে যথাসময়ে সরাসরি খাদ্যশস্য কিনতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীদের যেকোনো ধরনের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে কৃষকের জীবনকে আরও দুর্বল করতে পারে। সুতরাং গুদাম বাড়ানো এবং হিমাগার তৈরির মতো বৃহৎ কর্মসূচির আশু বাস্তবায়ন দরকার।