অর্থনীতিতে সুশাসন ফেরানো দরকার

আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হিসেবে জাতীয় সংসদে তাঁর প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন আমি তাঁর সতীর্থ ছিলাম। এ ছাড়া একই এলাকায় আমাদের জন্ম। প্রাক্তন সতীর্থ ও বন্ধু হিসেবে তাঁকে আন্তরিক অভিনন্দন!

অর্থমন্ত্রী জাতিকে একটি মেগা বাজেট উপহার দিয়েছেন। ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেটটি ১৯৭২-৭৩ সালের ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেটের তুলনায় ৬৬ হাজার ৪৬৪ শতাংশ বেশি। এমনকি গত অর্থবছরের ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেটের তুলনায় এটি ১৩ শতাংশ বেশি। বৃহৎ আকারের সবকিছুই সব সময় ভালো নয়। অর্থমন্ত্রীর বাজেটেও সবকিছু ভালো নয়। বস্তুত তাঁর বাজেটে গুরুতর দুর্বলতা রয়েছে। রয়েছে সুশাসনের চরম ঘাটতি। সুশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ন্যায়পরায়ণতা। আরেকটি উপাদান হলো স্বচ্ছতা-জবাবদিহি তথা দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অনুপস্থিতি। আমার বন্ধুবর অর্থমন্ত্রীর বাজেটে ন্যায়পরায়ণতার ও দুর্নীতি রোধের কার্যকর উদ্যোগের ভীষণ অভাব রয়েছে। এ ছাড়া বছরের পর বছর স্বার্থান্বেষীদের স্বার্থে অনেক প্রকল্প এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত রাখাও সুশাসনের পরিপন্থী।

অর্থমন্ত্রী দরিদ্র পরিবার থেকে নিজের উঠে আসা নিয়ে প্রায়ই কথা বলেন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তাঁর নীতি দেখে মাঝেমধ্যে মনে হয় তিনি বাংলাদেশের অগণিত পিছিয়ে পড়া ও মধ্যবিত্ত মানুষের কথা ভুলে গিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বিত্তশালী ব্যক্তিদের একজন। নির্বাচনের সময় হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সংসদের ১০ জন সর্বাধিক ধনী ব্যক্তির মধ্যে তিনি একজন।

হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে আমাদের সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৬৫.৩৩ শতাংশ ব্যবসায়ী, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত। পোশাকশিল্প কর্মসংস্থানের, বিশেষত দরিদ্র পরিবার থেকে আসা নারীদের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় উৎস। এটি আমাদের রপ্তানি আয়েরও বৃহত্তম উৎস। তাই এ শিল্পকে উৎসাহিত করা আবশ্যক। তবে এই খাতকে ১ শতাংশ হারে বা ২ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত ভর্তুকি প্রদানের যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে। এই প্রণোদনা টাকার অবমূল্যায়নের মাধ্যমেও দেওয়া যেত। ভারতসহ আমাদের অনেক প্রতিবেশীর তুলনায় ডলারের বিপরীতে আমাদের টাকার মূল্য কৃত্রিমভাবে বেশি রাখায় তৈরি পোশাকশিল্পসহ অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্ববাজারে আমাদের প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। তাই অতিরিক্ত ভর্তুকি প্রদানের পরিবর্তে টাকার যৌক্তিক অবমূল্যায়নের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা যেত। এই ২ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা দরিদ্রদের সঞ্চয়ের কিংবা তাদের গৃহীত ঋণের বিপরীতে ভর্তুকি হিসেবে দেওয়া যেত। কিংবা তাদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করা যেত। সৃষ্টি করা যেত স্থায়ীভাবে শস্যবিমা প্রদানের সুযোগ। গ্রামীণ শিক্ষার মানোন্নয়নেও তা ব্যবহার করা যেত। ধানের দাম কম হওয়ার কারণে বিপর্যস্ত কৃষকদের মধ্যেও বিতরণ করা যেত। এর ফলে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী জাতীয় সম্পদে তাদের ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার অন্তত একটি নতুন সুযোগের সৃষ্টি হতো।

এ কথা কারও অজানা নয় যে আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হিস্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। সরকারি তথ্যানুযায়ী, আমাদের দেশে ৫ শতাংশ ধনী পরিবারের জাতীয় আয়ের শেয়ার ১৯৯১-৯২ সালের ১৮.৮৫ শতাংশ থেকে ২০১৬ সালে ২৭.৮৯ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে দেশের ৫ শতাংশ সর্বাধিক দরিদ্র পরিবারের শেয়ার ১.০৩ শতাংশ থেকে ০.২৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

তৈরি পোশাকশিল্প সম্পর্কে আরেকটি কথা না বললেই নয়। এই খাত ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ধরনের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে। এর ফলে এই শিল্পের শুধু প্রসারই ঘটেনি, এর মাধ্যমে এই শিল্পের মালিকেরাও ব্যাপক অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত যে শ্রমিকদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাধ্যমে তাঁরা বিত্তশালী হয়েছেন, শ্রমিকদের জীবনমানে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেনি।

২০১৩ সালে পর্যালোচনা করে পোশাকশিল্প শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা করা হয়। ২০১৮ সালে পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে তা ৮ হাজার টাকা করে ৫১ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির দাবি করা হয়। আইনানুযায়ী শ্রমিকদের মজুরি বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে বাড়ার কথা, যার ফলে ২০১৭ সালে তাঁদের মজুরি হওয়ার কথা অন্তত ৬ হাজার ৫০০ টাকা। তাই গত বছর সরকার ও মালিকদের পক্ষে শ্রমিকদের ৫১ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির দাবি ছিল নিতান্তই একটি শুভংকরের ফাঁকি। এরপরও তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের পক্ষ থেকে শুধু তাঁদের জন্য টাকার ৫ শতাংশ অবমূল্যায়নের এবং ৫ শতাংশ ভর্তুকির দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। প্রসঙ্গত, এর আগে মালিকদের পক্ষ থেকে পোশাকশ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আনার দাবিও ছিল অযৌক্তিক।

অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেটে গত বছরের তুলনায় সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতা বৃদ্ধি করে মোট ব্যয়ের ১৩.৯২ শতাংশ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে এখানেও একটা শুভঙ্করের ফাঁকি বিরাজমান। কারণ, এই খাতে ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে মোট ব্যয়ের ১৪.৫৫ শতাংশ ছিল। এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ আইনের বিধান অনুযায়ী ওয়ার্ডসভার মাধ্যমে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এসব স্কিমের উপকারভোগী চিহ্নিত না করার কারণে যোগ্য ব্যক্তিরা অনেক ক্ষেত্রেই এসব সুযোগ না পাওয়ার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

অর্থমন্ত্রী বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রেখেছেন, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক। কালোটাকার মালিক বিত্তবানেরা এ সুযোগের মাধ্যমে দুভাবে লাভবান হবেন। একদিকে তাঁরা যেমন কর ফাঁকি দিয়ে অন্যায়ভাবে বিত্তের মালিক হয়েছেন, একইভাবে তাঁরা কম হারে কর দিয়ে এ টাকা বিনিয়োগ করে আরও বিত্তশালী হওয়ার সুযোগ পেলেন। এ ছাড়া বাজেটে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদের মালিকদের সারচার্জ দিতে হবে না। দুর্ভাগ্যবশত কম বিত্তের মানুষদের জন্য এ ধরনের কোনো সুযোগই নেই।

পক্ষান্তরে অর্থমন্ত্রী স্মার্ট মোবাইল ফোন আমদানির ওপর সম্পূরক শুল্ক ১৫ শতাংশ বাড়ানোর এবং মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহার করে প্রদত্ত সেবার ওপর অতিরিক্ত ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও সিম কার্ডের ওপর অতিরিক্ত ১০০ টাকা কর ধার্য করার প্রস্তাব করেছেন। মোবাইল ফোন এখন সাধারণ মানুষের জন্যও একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে এবং এর ওপর অতিরিক্ত কর দরিদ্র মানুষকেই অধিক চাপে ফেলবে। বাজেটে কৃষকের জন্য উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রদানের কোনো ব্যবস্থা নেই, যা ন্যায়পরায়ণতার নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সঞ্চয়পত্রের ওপর অতিরিক্ত উৎসে করও মধ্যবিত্তদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।

সরকারের জবাবদিহির পদ্ধতি দুটি, ‘ভার্টিক্যাল’ বা নিম্নমুখী, যা ভোটের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়; ‘হরাইজন্টাল’ বা সমান্তরাল, যা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে নিশ্চিত হয়। এ ছাড়া দুদকেরও এ ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের বদৌলতে ভোটের মাধ্যমে আমাদের সরকারের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। সংসদে কৃত্রিম বিরোধী দল সৃষ্টির কারণে সংসদীয় জবাবদিহির বর্তমানে আশা করা দুরাশামাত্র। দুদকের পক্ষ থেকেও মেগা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদ্যোগ এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না, যদিও এসব দুর্নীতি লাগামহীনভাবে চলছে।

মেগা দুর্নীতির উৎস মেগা অবকাঠামো প্রকল্প। প্রস্তাবিত এডিপিতে পরিবহন খাতের অবকাঠামো নির্মাণে ৫২ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে দেওয়া হয়েছে ২৬ হাজার ১৭ কোটি টাকা। ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ণ খাতে ২৪ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ১০টি ফাস্ট ট্র্যাক মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩৯ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা (যুগান্তর, ১৪ জুন ২০১৯)। সরকারের ঘোষিত জিরো টলারেন্স সত্ত্বেও এসব প্রকল্পে দুর্নীতি রোধে বাজেটে কোনো নির্দেশনা নেই। অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাজেটে আর্থিক খাতে দুর্নীতি রোধে কোনো পদক্ষেপও অনুপস্থিত। তবে এসব প্রকল্পের সীমাহীন দুর্নীতি আমাদের ভবিষ্যতে চরম সংকটের দিকেই ঠেলে দিতে পারে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক