দল, সরকার ও রাষ্ট্র যখন একাকার

বাঙালি ইতিহাসমনস্ক নয়, এমন অভিযোগ আছে। পাল্টা নালিশও আছে যে বাঙালি অতীতচারী। পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটতেই সে পছন্দ করে, সামনের দিকে তাকানোর তার সময় কই। দুটোই সত্য। আমরা অতীত থেকে শিখি না। অতীতের নির্যাসটুকু পাথেয় হিসেবে ঝুলিতে ভরে ভবিষ্যতের পথ তৈরি করি না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকালে এমনটিই মনে হয়।

একসময় ভারত নামে ইংরেজদের বিশাল এক উপনিবেশ ছিল। ইংরেজ চলে গেছে। ভারত তিন টুকরা হয়ে এখন হিন্দুস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ নামে মানচিত্রে বহাল আছে। ইংরেজরা তাদের উপনিবেশগুলোতে সীমিত আকারে গণতন্ত্রের চর্চা করত। এতে অনেক লাভ ছিল। জনবিক্ষোভ প্রশমিত রাখার জন্য স্পেস তৈরি হতো। এভাবেই তৈরি হয়েছিল ১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং ১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। ১৯৩০-এর দশকে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাংলা মুলুকে কৃষক-প্রজা পার্টি বেশ জোরকদমে এগিয়েছিল। কংগ্রেসে টিকতে না পেরে সুভাষ চন্দ্র বসু তৈরি করেছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লক। তাঁদের অবর্তমানে ওই দলগুলো হারিয়ে গেছে। পুরোনো উল্লেখযোগ্য আরেকটি দল হলো কমিউনিস্ট পার্টি। এটা কখনোই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। এলিটিস্ট নেতৃত্বের এই দলটি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে এখন সিন্দুকে ঠাঁই পেয়েছে।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় জন্ম নিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। আজ তার বয়স সত্তর। সময়ের বিচারে দলটি নিঃসন্দেহে প্রবীণ। নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে এই দলটি এখনো প্রবল প্রতাপে ক্ষমতার কেন্দ্রে টিকে আছে। একদা মহা পরাক্রমশালী কংগ্রেস এখন হিন্দুস্তানের রাজনীতিতে রীতিমতো কোণঠাসা। সেখানে নবশক্তির উত্থান হয়েছে। মুসলিম লীগের প্রদীপ পাকিস্তানে নিবুনিবু। বাংলাদেশে (একদা পূর্ব বাংলায়) এই দলটির দাফন হয়ে গিয়েছিল ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ কেন ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়ল, কমিউনিস্ট পার্টি কেন রাষ্ট্রক্ষমতা হাতের মুঠোয় পুরতে পারল না, কেন আওয়ামী লীগ এখনো নিজ বলয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ধরে রাখতে পারছে, এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হতে পারে।

একটা কথা সত্য যে আওয়ামী লীগ ক্রমাগত নিজেকে বদলে দিচ্ছে। আজকের প্রজন্ম হয়তো জানেও না, কারা কীভাবে আওয়ামী লীগ তৈরি করেছিল। এ নিয়ে বেশ কিছু কিতাব থাকলেও কে আর ওই সব পড়ে। হাতের তালুতে আছে উইকিপিডিয়া। সেখানে হঠাৎ করেই কেউ যদি ঢুঁ মারে, সে কিছু তথ্য পেয়ে যেতে পারে। তবে উইকিপিডিয়ার তথ্যের সত্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক।

পুরান ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে ছিল মুসলিম লীগের ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ বা কর্মী শিবির। কলকাতা এবং ঢাকায় যারা মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সমর্থক-ভক্ত ছিলেন, তাঁরা চালাতেন এই কর্মী শিবির। মুসলিম লীগের বিক্ষুব্ধ তরুণেরা তখন ঢাকার নবাববাড়িকেন্দ্রিক মুসলিম লীগ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছিলেন। তাঁদের এই পথচলা গিয়ে থামে টিকাটুলীর কে এম দাস লেনে অবস্থিত রোজ গার্ডেনে। মুসলিম লীগের গণতন্ত্রায়ণের দাবিতে তাঁরা তৈরি করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ বাদ পড়ে। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জায়গায় আসে বাংলাদেশ।

২৩ জুন (১৯৪৯) বেলা তিনটায় রোজ গার্ডেনের দোতলার হলঘরে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে মুসলিম লীগ কর্মীদের এক অধিবেশনে তৈরি হয় এই ইতিহাস। দলের নাম প্রস্তাব করেছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনিই দলের ৪০ জনের একটি সাংগঠনিক কমিটি ঘোষণা করেছিলেন। তিনি সভাপতি, টাঙ্গাইলের যুবনেতা সামসুল হক সাধারণ সম্পাদক। পাঁচজন সহসভাপতির মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমেদ খান, আলী আমজাদ খান এবং আবদুস সালাম খান। কোষাধ্যক্ষ ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাবন্দী। তাঁকে কার্যনির্বাহী কমিটির যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। এটি করা হয়েছিল মাওলানা ভাসানীর আগ্রহে ও চাপে। তিনি শেখ মুজিবের পেছনে ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেখতে পেয়েছিলেন। জানি না, সত্তর বছর পরে দলের নেতা-কর্মীরা দলের প্রতিষ্ঠাতাদের স্মরণ করেছেন কি না।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কমিটির প্রথম সভা হয়েছিল ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে। সামসুল হকের লেখা ‘মূল দাবি’ অনুসরণ করে দলের খসড়া ঘোষণাপত্র তৈরি হয়েছিল। এরপর দলের প্রথম অফিসটি চালু হয় ইয়ার মোহাম্মদ খানের ১৮ নম্বর কারকুনবাড়ি লেনে। মাওলানা ভাসানী ঢাকায় এলে এ বাড়িতেই থাকতেন। পরে আওয়ামী লীগের অফিস নেওয়া হয় সিমসন রোডে এবং পরে ৯৪ নম্বর নবাবপুর রোডে। সেখান থেকে পুরানা পল্টন হয়ে আওয়ামী লীগ অফিস এখন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে।

আওয়ামী লীগের পথচলা শুরু হয় গণতন্ত্রের দাবিতে। এরপর এর সঙ্গে যোগ হয় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি। প্রধানত এ দুটো দাবি নিয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জনসম্পৃক্ত রাজনীতির শক্ত ভিত তৈরি করতে পেরেছিল, সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল এর ব্যাপ্তি। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল ম্যান্ডেট এসেছিল এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, আওয়ামী লীগ তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়লেও সাংগঠনিকভাবে ততটা শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রায়ই বলতেন, তাঁর মূল শক্তি হলো ছাত্রলীগ। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা থেকে রূপান্তরিত হলেন জাতীয় নেতায়। তিনি হলেন ‘বঙ্গবন্ধু’। দলকে ছাড়িয়ে তিনি তখন অনেক ওপরে। দল তাঁকে ধারণ করতে পারেনি। যে যুবশক্তি এবং জনগোষ্ঠী তাঁকে ‘জাতির পিতার আসনে বসিয়েছিল, তাঁরা তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। বাঙালি জাতির প্রাণভোমরা এখন আওয়ামী লীগের লোগো। আওয়ামী লীগের নেতারা এখন নতুন করে ইতিহাসের কথা বলছেন। সেই সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে সরকারি ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণও। আমরা দেখছি, দলের প্রচারে থাকে সংকীর্ণতা, আত্মসন্তুষ্টি।

আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ছিল, তখন ছিল তার এক ধরনের রূপ। তাতে ধৈর্য ছিল, গতি ছিল, ত্যাগ ছিল, স্বপ্ন ছিল। দলটি সরকারে যাওয়ার পর থেকেই এটি বদলে যেতে থাকে। মাঠের রাজনীতি আর রাষ্ট্র পরিচালনা যে এক বিষয় নয়, এটা তাঁরা অনেক সময় বুঝতে চান না। যে কথা যে ভাষায় পল্টন ময়দানের মঞ্চে বলা যায়, সেটি সংসদ অধিবেশনে বলা যায় না। দেশটা এগিয়েছে অনেক। রাজনৈতিক দলগুলো সে অনুযায়ী এগোয়নি, আওয়ামী লীগও নয়।

টানা দশ বছরেরও বেশি ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এখন দল, সরকার ও রাষ্ট্র একাকার। দল সরকার চালায় না। সরকার দল চালায়। ক্ষমতার কেন্দ্র এখন ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ নয়, যেমনটি ছিল ১৯৭০-৭১ সালে ৫১ পুরানা পল্টন।

শরৎচন্দ্রের বিলাসী গল্পে পড়েছিলাম, ‘টিকিয়া থাকাটাই চরম সার্থকতা নহে। অতিকায় হস্তী লোভ পাইয়াছে, কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে।’ আওয়ামী লীগ সরকার টিকে থাকবে ততদিন, যতদিন দলটির পক্ষে দুটো শর্ত কাজ করবে। এক, রাষ্ট্রশক্তির নিরঙ্কুশ সমর্থন। দুই. চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো সক্ষম রাজনৈতিক বিকল্প দৃশ্যমান না হওয়া। শর্তগুলো এখনো আওয়ামী লীগের পক্ষে।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]