বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা যেন অটুট থাকে

সুন্দরবন এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদাটি হারাতে বসেছে
সুন্দরবন এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদাটি হারাতে বসেছে

অবশেষে ইউনেসকো সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সুপারিশ করেছে। সিদ্ধান্তটি ইউনেসকোর সদর দপ্তর প্যারিস থেকে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র কর্তৃক ৭ জুন ২০১৯ প্রকাশিত প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়। ঘোষণাটি বাংলাদেশের জনগণকে অবাক করে এই কারণে যে ২০১৭ সালে পোল্যান্ডে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি ৪১তম সভায় সুন্দরবনের ওপর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার জনসাধারণকে জানিয়ে আশ্বস্ত করেছিল যে ইউনেসকো সুন্দরবনের সন্নিকটে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র রামপাল নির্মাণে তার আপত্তি প্রত্যাহার করেছে। এরপর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ চলমান রাখা হয়। কিন্তু ৭ জুন ২০১৯ প্রকাশিত ইউনেসকোর প্রতিবেদন এবং ২০১৭ সালে পোল্যান্ডে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪১তম সভার সিদ্ধান্ত লক্ষ করলে দেখা যায় যে সরকার কর্তৃক জনসাধারণকে দেওয়া তথ্যটি পুরোপুরি ভুল ছিল। ভুলটি অনিচ্ছাকৃত, না কোনো বিশেষ মহলের স্বার্থ হাসিলের জন্য ইচ্ছাকৃত কৌশলী ভুল, নাকি নেহাত মিথ্যাচার ছিল, তার বিশ্লেষণ হতেই পারে। তবে এসবের যেকোনোটিই সরকারের জন্য বিব্রতকর হবে, তা নিশ্চিত। যা-ই হোক, ইউনেসকোর বর্তমান সুপারিশটি জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪৩তম সভায় চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করা হবে।

৭ জুন ২০১৯ প্রকাশিত ইউনেসকোর সুপারিশে উল্লেখ করা হয়, ‘বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের দূষণের বিপদ ঠেকাতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি। বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির অনুরোধ সত্ত্বেও রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা অবলম্বন করার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি; বরং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ চলমান রাখা হয়েছে। নদীর ভাটি এলাকায় বায়ু ও পানিদূষণের উচ্চ মাত্রার ঝুঁকি, নদীতে অধিকতর হারে জাহাজ চলাচল, নদীর খননকাজ ইত্যাদির ব্যাপারে কমিটির উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে গৃহীত সিদ্ধান্ত ৪১ সিওএম ৭ বি.২৫ মারফত বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছিল, এটি যেন নিশ্চিত করা হয় যে সুন্দরবনসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা করার আগে কোনো ধরনের বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা অন্য অবকাঠামো নির্মাণকাজ করা থেকে বিরত থাকবে। কমিটির উপরিউক্ত সিদ্ধান্তে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। অধিকন্তু মোংলা বন্দরের আশপাশে গৃহীত ১৫৪টি শিল্প প্রকল্পের বাস্তবায়ন সুন্দরবন এলাকায় অধিকতর হারে জাহাজ চলাচল ও নদী খননকাজ বৃদ্ধি করবে এবং প্রতিটি প্রকল্প পরিবেশদূষণে প্রভাব ফেলবে। অতএব, এটি সুপারিশ করা হলো যে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুক।

সুন্দরবনের কাছে রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি কর্তৃপক্ষ দুটি ভুল ধারণা ধরে নিয়ে প্রথম থেকে এগিয়ে চলেছে। যথা ১. রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না। ২. যে দূষণ কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে সৃষ্টি হবে, তা অত্যাধুনিক যন্ত্রাদির দ্বারা সবটা আটকে দেওয়া হবে। এ দুটি ধারণাকেই দেশি-বিদেশি পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরা এবং ইউনেসকো অযৌক্তিক বলে নাকচ করে দেয়। এদিকে দেশি পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় সুন্দরবন রক্ষা কমিটি তাদের চলমান আন্দোলনের একপর্যায়ে সরকারের অতি উচ্চপর্যায়ে প্রভাবশালী এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ পায় যে কমিটি যেন সরকারি বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে আলোচনায় বসে, যাতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সুন্দরবনের ক্ষতির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যায়। এই কর্তাব্যক্তি অনেকটা জনসমক্ষেই এ মত প্রকাশ করেন যে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের ক্ষতি করবে বলে যাঁরা দাবি করছেন, তাঁরা নেহাত না জেনে বা না বুঝেই তা করছেন। এমতাবস্থায় জাতীয় সুন্দরবন রক্ষা কমিটির সদস্যরা আমন্ত্রণটি আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেন এবং তাঁদের বৈজ্ঞানিক তথ্য ও বক্তব্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে উপস্থাপন করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ওই কর্তাব্যক্তিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। শুধু তা-ই নয়, রামপালের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হওয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসহ ১৩টি রিপোর্ট ওই কর্তার নির্দেশিত দপ্তর ঠিকানায় পৌঁছে দেয়, যাতে অপর পক্ষের আলোচকদের আলোচনা করতে সুবিধা হয়। কিন্তু প্রায় দেড় বছর সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও আলোচনার কোনো তারিখ বা ইঙ্গিত কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে দেওয়া হয়নি, যদিও ইতিমধ্যে জাতীয় সুন্দরবন রক্ষা কমিটি দুটি তাগিদপত্র প্রদান করেছে।

রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের যে দূষণ ও ক্ষতি হবে, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসহ যে ১৩টি রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে, সেগুলো কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাব নিয়ে কাজ করে, এমন অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রণীত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক চার্লস ড্রিসকল (রামপাল থেকে নির্গত পারদের দূষণ), ড. চার্লস নরিস (রামপাল থেকে নির্গত ছাইয়ের দূষণ), ড. রণজিৎ সাহু (রামপাল থেকে নির্গত গ্যাসের দূষণ), অধ্যাপক ডেভ নেইমার (রামপাল থেকে নির্গত কয়লার গুঁড়ার দূষণ), ডোনা লিসেনবি (রামপাল থেকে নির্গত পানির দূষণ) অন্তর্গত। এ ছাড়া বিশ্বখ্যাত পরিবেশবিষয়ক সংস্থা গ্রিনপিস কর্তৃক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে দূষণের সামগ্রিক পর্যালোচনা এবং রামপাল দূষণের ওপর ইউনেসকোর নিজস্ব মূল্যায়ন উল্লেখযোগ্য। এসব রিপোর্টে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে এসব দূষণ সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোধ করা হবে বলে যে দাবি করা হয়, তাতে দ্বিমত পোষণ করা হয়।

সুন্দরবনের ওপর রামপালের দূষণ সম্পর্কে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের বিস্তর নেতিবাচক মূল্যায়ন থাকা সত্ত্বেও এটি নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ তা আমলে না নিয়ে কেন একগুঁয়েমি মনোভাবে অনড় রয়েছে, তা বোধগম্য নয়। ইউনেসকো ২০১৭ সালে রামপালের বিষয়ে তার মূল্যায়নের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়ে সতর্ক করে ও পরামর্শ অনুয়ায়ী সুন্দরবনের সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায়। শর্ত অনুযায়ী ইউনেসকো দুই বছরব্যাপী বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণে রাখে ও বাংলাদেশের গৃহীত ব্যবস্থাগুলো পুনর্মূল্যায়ন করে ইউনেসকো তার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী ইউনেসকো বর্তমানে সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সুপারিশ করে। দুঃখজনক যে বাংলাদেশ ইউনেসকোর সঙ্গে একটি সমঝোতামূলক কার্যক্রম চালাতে ব্যর্থ হয়েছে; সুন্দরবনের সুরক্ষায় ব্যবস্থা নিতে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশ এসব কিছুর মধ্যে সততা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখেনি, বরং পুরো বিষয়টি নিয়ে কখনো ভুল, কখনো অসত্য তথ্য দিয়ে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করেছে।

ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আমাদের সুন্দরবন এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদাটি হারাতে বসেছে। সুন্দরবন ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে পরবর্তী সময়ে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। এটা হবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনক। তাই বাংলাদেশের উচিত হবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীদের যুক্তি ও ইউনেসকোর পরামর্শ আমলে নিয়ে সুন্দরবনের ওপর রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষিত প্রভাব রোধ করার লক্ষ্যে রামপাল প্রকল্প বাতিল করা। এতে সরকারের ভাবমূর্তি সমুন্নত থাকবে। ইতিহাস তা মনে রাখবে।

বদরূল ইমাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক