বাংলাদেশের উর্দুভাষী মানুষ ও কবির আর্তি

আহমেদ ইলিয়াসকে অল্পসংখ্যক বাংলাদেশিই জানেন। যদিও তাঁর পরিচিতি রয়েছে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে, কিন্তু দেশে স্বীকৃতি পাননি তিনি। উর্দুতে কবিতা লেখেন তিনি, উর্দুই তাঁর মাতৃভাষা। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে যে ভাষা এখানে মৃতপ্রায়।

বাংলাদেশে উর্দুকে পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিয়ে চিন্তা করার রেওয়াজ। অথচ ভারতেও বিপুল মানুষের ভাষা এটা। সেখানে ২২টি সরকারি ভাষার একটি উর্দু। সাত রাজ্যে এটা ‘অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ’।

উর্দু কবি হিসেবে আহমেদ ইলিয়াসের খ্যাতি রয়েছে ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের কাব্যজগতেই। কলকাতাতে জন্ম তাঁর। দেশভাগ এখানে নিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশ ও কবিতা—এই দুটোই তাঁর প্রেম। দুটোই আঁকড়ে ধরে আছেন। কিন্তু জীবনসায়াহ্নে এ রকম লিখিয়েদের দেখতে হচ্ছে মাতৃভাষার বিপন্ন দশা। যদিও এখনো উর্দু বলতে পারে অনেকে, কিন্তু পড়তে পারা মানুষ অতি নগণ্য। এর প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার সুযোগ মরে গেছে।

একসময় ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের লায়েল উন নাহার-এর ঢাকা প্রতিনিধি ছিলেন আহমেদ ইলিয়াস। সাপ্তাহিকটির সম্পাদনা পরিষদেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা বিপুল। বাংলাদেশে উর্দুভাষীদের মুরব্বি তিনি। সম্প্রতি এক দুপুরে খুলে ধরেছিলেন আশা ও আশাভঙ্গের বিপুল ভান্ডার, যেখানে রাষ্ট্রনৈতিক টানাপোড়েনে তাঁর জনগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলার শঙ্কাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। অথচ এদেরই প্রগতিশীল অংশ একদা ঝুঁকি নিয়ে স্লোগান দিয়েছিল: ‘তেরে নাজাত, মেরে নাজাত—ছে নুকাত ছে নুকাত’ (তোমার মুক্তি, আমার মুক্তি—ছয় দফা, ছয় দফা)।

যে ‘নাগরিকদের’ স্থান এখনো ক্যাম্প

উদ্বাস্তুদের জন্য তৈরি ক্যাম্পে আছে বাংলাদেশের প্রায় চার লাখ উর্দুভাষী। উচ্চ আদালতের নির্দেশে তারা এ দেশেরই নাগরিক। ক্যাম্পের বাইরেও আছে আরও তিন লাখ উর্দুভাষী।

প্রচারমাধ্যমে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যন্ত্রণাদগ্ধ উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে প্রায়ই সংবাদ দেখা যায়। কিন্তু খোদ দেশের রাজধানীতে এমনও ‘ক্যাম্প’ রয়েছে, যেখানে প্রায় ৪০ হাজার উদ্বাস্তু ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন। ১ লাখ ৩৫ হাজার বর্গফুটের মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে প্রতি বর্গফুটে তিনজনের বেশি মানুষের বাস!

একজন কবিকে মানবিক বিষণ্নতা বেশি স্পর্শ করবে, এটা স্বাভাবিক। আহমেদ ইলিয়াস তাঁর সমাজের ক্যাম্প বাসিন্দাদের সহায়তা করছেন গত চার দশক। তাঁর দাবি, মোহাম্মদপুরের ‘জেনেভা ক্যাম্প’টি বিশ্বে এইরূপ সর্ববৃহৎ আশ্রয়স্থল। এত অল্প পরিসরে এত অধিক মানুষ বিশ্বের কোনো শরণার্থী শিবিরে নেই।

যাঁরা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং ঢাকায় উর্দুভাষীদের ক্যাম্প দেখেছেন, তাঁরা স্বীকার করবেন, শেষোক্ত ক্যাম্পগুলোতে বসবাসও চরম দুঃসহ। বাংলাদেশে এরূপ ১১৬টি ক্যাম্প আছে। ঢাকাতে রয়েছে ৪৫টি। চট্টগ্রামে আছে ৬টি ক্যাম্পে প্রায় ২৫ হাজার। ক্যাম্পের বয়স যত বাড়ছে, জনসংখ্যা তত উপচে পড়ছে; যদিও আয়তন বাড়ছে না। উচ্চতর প্রশাসনিক নির্দেশ থাকলেও কেবল বিলম্বিতই হচ্ছে এসব ক্যাম্পের দুর্গত জীবনের অবসান। পুনর্বাসন পেছালেও ঢাকার মিরপুরসহ কয়েকটি স্থানে প্রত্যহ তাদের ঘুমাতে যেতে হয় উচ্ছেদ–আতঙ্ক নিয়ে।

দেশজুড়ে অনেক ক্যাম্পেই রয়েছে পাসপোর্ট না পাওয়ার সমস্যা। জাতীয় পরিচয়পত্র থাকার পরও এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক অনাপত্তি সত্ত্বেও ক্যাম্পবাসীর অনেকে পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যাত হন। যার কোনো সদুত্তর মেলে না কোনো দপ্তর থেকে।

ক্যাম্পবাসীদের সমস্যায় বাইরের উর্দুভাষীদের সংহতি প্রত্যাশামতো নয়। তারা অর্থকড়িতে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী কয়েকজনের উদ্যোগে ১৯৮১ সালে ‘আল ফালাহ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। উদ্বাস্তু উর্দুভাষীদের মানবিক সহায়তা দেওয়াই ছিল উদ্যোগের লক্ষ্য। এই সংস্থার কার্যালয়ে বসেই কবি আহমেদ ইলিয়াস জানাচ্ছিলেন, কীভাবে ৪০ বছরে ক্যাম্পগুলোর জনমনস্তত্ত্ব পাল্টে গেছে। বর্তমানে উর্দুভাষীদের সব ক্যাম্পে বাসিন্দাদের ৮০ ভাগের জন্ম ১৯৭১-এর পর। তারা নিজেদের বাংলাদেশিই ভাবে। এক দশক হলো আদালতের অনুমোদনেই তারা এখানকার পরিচয়পত্র নিয়েছে, ভোট দিচ্ছে। পূর্বপুরুষদের বিষণ্নতার মানসিক ক্ষত কাটিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে আগ্রহী সবাই। বাংলাদেশেই পুনর্বাসিত হতে চায় তারা। সরকারের মনোভাবও ইতিবাচক। যদিও উর্দুভাষীদের নিয়ে মূল সমাজ স্বচ্ছন্দ নয়।

কিন্তু আহমেদ ইলিয়াসের বিষণ্নতার ভিন্ন কারণ আছে। উর্দুতে লিখিত তাঁর অসামান্য কবিতাগুলো হয়তো অনাগত সেই ভবিষ্যতের এখানে অপঠিতই থাকবে। বাংলাদেশে উর্দু ছোটগল্পের ঐতিহ্য মরে গেছে বহু আগেই। যে দেশ ‘মাতৃভাষা’র বিকাশে অসামান্য এক বৈশ্বিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে, সেই দেশেই ৭-৮ লাখ মানুষের ‘অপর’ একটি ভাষার লিখন-পঠনের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য প্রায় বিলীন হয়ে গেল।

শহরাঞ্চলে পুনর্বাসিত হতে চায় তারা

উর্দুভাষী ক্যাম্পের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন ২০১৪ সালের নভেম্বরে। অনেক বছর হলেও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি কম। পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি পাওয়াও সহজ নয়। ক্যাম্পগুলোতে ঘুরে মনে হলো, বাসিন্দারা পুনর্বাসন চাইছে শহরাঞ্চলেই। রুটি-রুজির ইতিমধ্যে সৃষ্ট উপায়গুলো রক্ষা করতে চায় তারা। খাবারের দোকান, কাপড়ে জরি বসানো, চুল কাটা, অটোমোবাইলের কাজ—এসবই তাদের আয়–রোজগারের উৎস, যা হারাতে চায় না তারা। এর মধ্যেই ঢাকার অনেক ক্যাম্পে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের নোটিশ এসেছে। উদ্বাস্তু ক্যাম্প বলে এত দিন ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় থেকেই দেওয়া হতো এটা। বিদ্যুৎ বিভাগ এখন বলছে, যাঁদের ভোটার তালিকায় নাম আছে, তাঁদের খরচ সরকার বহন করবে না। এ নিয়ে ক্যাম্পে ক্যাম্পে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

শিক্ষার ক্ষেত্রে পুরোনো বঞ্চনা আর নেই। ক্যাম্পগুলোর আশপাশে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে নির্বিঘ্নে ভর্তি হতে পারছে শিশু-কিশোরেরা। যদিও দারিদ্র্যের কারণে উচ্চশিক্ষায় প্রায় অনুপস্থিত উর্দুভাষী তরুণ-তরুণীরা। চার দশক আগে এই জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও অর্থনৈতিক জীবনে যে ব্যাপক বিষণ্নতা তৈরি হয়, তার রেশ এখনো প্রবল। ৩৫-৪০ হাজার মানুষের জেনেভা ক্যাম্প থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া পাওয়া গেল মাত্র একজন।

শিক্ষা ও আর্থিক নাজুকতাই মূলত এই জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে কেবল মুখের ভাষায় পরিণত করেছে। চট্টগ্রামে হামজারবাগ, ফিরোজ শাহ প্রভৃতি কলোনির তরুণেরাও বলছিলেন, সামাজিক বিরাগ এড়াতে অনিচ্ছায় হলেও তাঁরা উর্দুকে বাদ দিয়েছেন। অথচ এককালে পাসবান, ওয়াতানসহ পাঠকপ্রিয় অনেক উর্দু সংবাদপত্র ছিল এই অঞ্চলে। ঢাকার নবাবপুর রোডের হোটেলগুলোতে উর্দু কবিদের আড্ডা বসত, যাঁরা উপমহাদেশজুড়ে আমন্ত্রিত হতেন মুশায়েরায়। কিন্তু পরবর্তী দৃশ্যটি বোঝা যায় আহমেদ ইলিয়াসের কাব্যগ্রন্থ হরফে দরিদা (ছিন্নভিন্ন অক্ষর), আয়নে রেয (চূর্ণ-বিচূর্ণ আয়না) ইত্যাদি নাম থেকে। একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন:

...যখন পথ চলা শুরু করি

আমার সাথে ছিল শুধু পথ চলা

ছেড়ে এলাম ঘর যখন

আমার নাম ছিল, ছিল পরিচয়

আমার শব্দ ছিল, ছিল ভাষা

আমার অস্তিত্বের ছিল অংশ এরা, এরা ছিল সব;

এখন কোথায় এসে থেমেছি আমি

আশপাশে কোথাও কিছু নেই

জিভে নেই কোনো ভাষা

ঠোঁটের আড়ালে নেই কোনো শব্দ

এ কীসের খোঁজ আমার?

[তর্জমা: জাভেদ হুসেন]

৮৫ বছর বয়সী কবিকণ্ঠের এই আর্তিকে একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষার আবেদন আকারে দেখা যায়। বাংলাদেশের জন্য এটা গৌরবের হবে যদি উর্দুভাষীদের পুনর্বাসনে যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তাতে মাতৃভাষার লিখন-পঠনে মদদ দানকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এভাবে আমরা আরও জোরের সঙ্গে বলতে পারব, কোনো ভাষার বিরুদ্ধে নয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্বের বিরুদ্ধে। উর্দুভাষী মানুষগুলোকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে এসে বাংলাদেশ একাত্তরের বিজয়কে নৈতিকভাবে আরও বড় উচ্চতায় নিতে পারে।

আলতাফ পারভেজ গবেষক