সুশাসনের ঘাটতি মেটাবে আদালত?

সুশাসনের ঘাটতি খুব বেশি হলে সেটা যে বিচার বিভাগ বা রাষ্ট্রের অন্য কোনো স্তম্ভ খুব মেটাতে পারে না, তা আমরা টের পাচ্ছি। সাম্প্রতিককালে আমাদের উচ্চ আদালত থেকে এমন সব জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে আদেশ আসছে, যা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। কিন্তু এই কাজগুলো করার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের। তাদের ব্যর্থতার জবাবদিহি মূলত করার কথা সংসদের। মন্ত্রিসভার যৌথ জবাবদিহি কথাটির কী অর্থ, তা বাংলাদেশের রাজনীতির কুশীলবেরা সম্ভবত ভুলতে বসেছেন।

বিচার বিভাগের অস্তিত্ব ন্যায়বিচারের জন্য। শাসনকার্যের সহায়ক শক্তি সে নয়। পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন (পিআইএল) বা জনস্বার্থে মামলার ধারণাটি বিশ্বের অনেক দেশেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রতিবেশী ভারতসহ এই উপমহাদেশে জনস্বার্থে মামলা জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সেটা মূলত শাসনগত ব্যর্থতা থেকেই। কিছু ব্যতিক্রম তো থাকবেই। কিন্তু সাধারণভাবে এটা বলা চলে যে উন্নত গণতন্ত্রে এর প্রকোপ তেমন দেখা যায় না। পরিবেশের একটি মামলাকে কেন্দ্র করে আশির দশকের শেষে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে পিআইএল স্বীকৃতি পায়। এরপর ধীরে ধীরে জনস্বার্থে রিট জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তবে ভারতের মতো বাংলাদেশেও ছদ্মবেশী পিআইএল নিয়ে সচেতন মহলের সতর্কবাণী আছে। কারণ, কেউ কেউ এর অপব্যবহার করতে পারেন।

অবশ্যই জনস্বার্থে মামলার ক্ষেত্রে আমাদের বেশ কিছু মাইলফলক অর্জন আছে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও প্রমাণিত হচ্ছে, নির্বাহী বিভাগ যদি রাজনৈতিকভাবে রুগ্ণ চিন্তার দ্বারা তাড়িত হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রে সুশাসনের ডিঙি নোঙর করে না। জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমকে রাজনীতির কুশীলবেরা অনেক সময় সমীহ করার ভান করেন। অনেক সময় দায়ে পড়ে মেনে নেন, এমনকি অনেক সময় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলে লোকদেখানো প্রশংসাও করেন। কিন্তু তাঁরা যা চান না, সেটা করতে বাধ্য হলে বেজার থাকেন।

সরকার, সংসদ ও রাজনীতি—কোনোটিই সুশাসন দিতে ও নিতে প্রস্তুত না থাকলে একটা বিভ্রাট বা অকার্যকারিতা প্রতীয়মান হয়। বিচার বিভাগের সদিচ্ছায় মাসদার হোসেন মামলার রায়ে বিচার বিভাগ পৃথক্করণ এসেছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, এক-এগারোর সরকারের সময় এটা এলেও এর প্রাণশক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হচ্ছে। পরোক্ষভাবে বিচার বিভাগের অনেক এখতিয়ার নির্বাহী বিভাগ কেড়ে নিচ্ছে। অধস্তন আদালত সংবিধানের তৈরি। অথচ তাঁর বিচারকদের মর্যাদা, মোবাইল কোর্ট বা আদালত অবমাননা আইন—যেখানেই নির্বাহী স্তম্ভের সংবেদনশীলতা, সেখানেই আমরা একটা ধীরে চলো নীতি দেখি। বিচারকদের মর্যাদা-সংক্রান্ত রায় আটকে আছে। মোবাইল কোর্ট আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ মামলার শুনানির গতি মন্থর। আদালত অবমাননা আইন, যেটি বলেছে, উচ্চ আদালতের রায় মান্য করা সম্ভব না হলে আমলাদের কাঠগড়ায় তোলা যাবে না, সেই আইন বাতিল করে রায় হয়েছে। কিন্তু আজ তিন বছরের বেশি হতে চলল, পূর্ণাঙ্গ রায় মিলছে না। এ রকম আরও কিছু বিষয় রয়েছে, যাতে নীরবতা বা সবাইকে দর্শক হতে দেখি।

সম্প্রতি যেসব বিষয় গণমাধ্যমে বেশ আলোচিত, তার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণ, খাদ্যে ভেজাল রোধ করা, দুদককে সচল করা, নদী দখলদারদের উৎখাত করা, অনাগ্রহী পুলিশকে তদন্ত করতে বাধ্য করা, সবশেষ আলোচিত হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণখেলাপিবান্ধব পরিপত্রের কার্যকরতা স্থগিত করা। এই সমস্যাগুলো আমজনতাকে প্রতিনিয়ত বেশ ভোগাচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রতিটির আইন আছে, লোকবল আছে, বাজেট আছে। কিন্তু সব থাকতেও কাজের কাজ করার সামর্থ্য নেই। ভোঁতা হয়ে গেছে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি থাকলে জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজম অর্থপূর্ণ হতে পারে না।

খেলাপি ঋণ রাজনৈতিক সদিচ্ছার সংকটের ফল। এর সঙ্গে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার সম্পর্ক বিরাট। ৩০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশের ঘটনার আগে ১৪ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকার ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এর আগেই খবর ছিল, মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণখেলাপির দুর্নাম ঘোচানোর মুখরক্ষার নতুন নীতি মূলত ক্ষমতাধর ঋণখেলাপিরাই করেছেন। এই তালিকার শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বাস্তব অস্তিত্ব প্রায় নেই। আবার ঋণখেলাপিদের একটি বড় অংশ হাইকোর্ট থেকেই তাঁদের খেলাপি বলা স্থগিত করাতে সক্ষম হয়েছেন। অনেকে বলেছেন, এই তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারত। এটা পরিষ্কার বোঝা সম্ভব যে আদালতের হস্তক্ষেপ ইতিবাচক হলেও এই প্রক্রিয়া ঋণ-প্লেগ থেকে আমাদের বাঁচাবে না।

যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সংসদে তথ্য দিয়েছেন, গত ১০ বছরে সড়কে ২৫ হাজার লোক নিহত হয়েছে। ভারতের আইনে, ক্লেইমস ট্রাইব্যুনাল অন্তত নিহত ব্যক্তির পরিবারকে বিনাবাক্যব্যয়ে ৫০ হাজার রুপি এবং আহতকে ২৫ হাজার রুপি দেওয়ার বিধান করেছেন। এই টাকার অঙ্ক আইনে নির্দিষ্ট আছে। সাবেক মন্ত্রী ও পরিবহনশ্রমিক নেতা শাজাহান খান একদা নিহত ব্যক্তিদের ৩০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন। সেই হিসাবে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর পাওনা ৭৫ কোটি টাকা। উন্নয়নের কিছু সূচকে ভারতীয়দের আমরা ছাড়িয়ে গেছি। ভারতীয়দের জীবনের দাম ৫০ হাজার রুপি হলে বাংলাদেশিদের জীবনের দামও তা-ই হওয়া উচিত। আর ভারতে এই নির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণের বিষয়টি শুধু সেই দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই কার্যকর, যেখানে অবহেলার অভিযোগ নেই। বাংলাদেশের বেশির ভাগই চালকের অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা। ভারতে সে ক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ বিচারকেরা মোটা অঙ্কে নির্ধারণ করতে পারেন। বাংলাদেশেও তা-ই ছিল। কিন্তু এই বিধান কীভাবে কাজ করে, তা আমরা দেখতেই পাইনি। কারণ, ক্লেইমস ট্রাইব্যুনাল চলুক, কোনো সরকার চায়নি।

প্রথম আলোর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলেছে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের জুন—এই সাড়ে তিন বছরে ২৫ হাজার মানুষ সড়কে নিহত হয়েছে। আহত সাড়ে ৬২ হাজার। এর প্রভাবে বার্ষিক ক্ষতি ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ। ঈদের পরে সংসদে তথ্য এসেছে, গত এক দশকে নিহত ২৫ হাজার। যদি আমাদের ভারতীয় আইনটির মতো একটা বিধান থাকত, তাহলে ওই সাড়ে তিন বছরে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলো পেত দেড় শ কোটি টাকা। আহতরা পেত ১৫৬ কোটি টাকার বেশি।

সরকার ক্ষতিপূরণ তো দিল না, উপরন্তু অকার্যকর থাকা আইনটা মেরে ফেলল। ১৯৮৩ সালের আইনের ক্লেইমস ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে নতুন আইনে ট্রাস্টি বোর্ড করেছে। কিন্তু বিধি না করায় তা অচল। অন্যদিকে, সেই ১৯৮৮ সাল থেকে অনধিক ১০টি মামলায় হাইকোর্ট মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ ধার্য করলেও দু-তিনটি ব্যতিক্রম বাদে উশুলের ইতিহাস করুণ।

আমরা অনেক সময় বলি, দেশে কতগুলো তদন্ত কমিটি হয়েছে এবং এর কতগুলোর প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি, তার তদন্তে একটি তদন্ত কমিশন হোক। এখন সময় এসেছে, হাইকোর্টের কতগুলো নির্দেশনা সরকার উপেক্ষা করে চলছে, তার একটি তালিকা গ্রন্থিত হওয়া দরকার। উচ্চ আদালতের আদেশকে যাঁরা ‘বন্ধনহীন গ্রন্থি’ মনে করছেন, তাঁদের কৈফিয়ত তলব করলে তাঁরা বিব্রত হন। সে জন্যই তাঁরা আদালত অবমাননা আইনে বিধান যুক্ত করেছিলেন যে আদেশ মানা না গেলে মামলা হবে না।

সম্প্রতি ৫২টি ভেজাল বা নিম্নমানসম্মত পণ্য নিষিদ্ধ হলো, কিন্তু ভেজালের দৌরাত্ম্য কমেনি। এর আগে ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানো অবৈধ ঘোষণা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম মুছে ফেলা, মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স, হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধ, এ সপ্তাহে যুক্ত হলো দুধ ও দই সরবরাহকারীদের তালিকা যাচাই, দুর্ঘটনা এড়াতে রুটভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন রঙের বাস চালানো, যানবাহনে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র বসানো, সড়ক-মহাসড়ক থেকে বিপজ্জনক বৈদ্যুতিক খুঁটি অপসারণ, মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশন বন্ধে নির্দেশনা, ফলমূলে কেমিক্যাল মেশানো, নদী দখলকারীদের নির্বাচন ও ব্যাংকঋণের অযোগ্য করা—আরও কত কী। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রমাণিত, শাসন বিভাগ রাজি না হলে এসবের বাস্তবায়ন দুরূহ। ঢাকার ৩৪টি স্থানে ওয়াসার পানি পরীক্ষার আদেশের পর সময় টিভিতে শিরোনাম দেখেছিলাম, হাইকোর্টকে ‘হাইকোর্ট’ দেখাচ্ছে।

গত মার্চে দুদককে হাইকোর্ট বলেছিলেন, ইঁদুর না ধরা বিড়ালের প্রয়োজন নেই। এ কথা শাসন বিভাগের কোন বিভাগের জন্য খাটে না, তারও একটা তালিকা হতে পারে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail. com